ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনারকে হত্যার উদ্দেশ্যে অপহরণের মামলায় গ্রেপ্তার শিলাস্তি রহমান (২২) আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। সোমবার (৩ জুন) বিকালে তাকে আদালতে হাজির করলে এই জবানবন্দি দেন তিনি। এদিন ঢাকা মহানগর পুলিশের অপরাধ ও তথ্য বিভাগের উপপরিদর্শক (এসআই) জালাল উদ্দিন রাত পৌনে ৮টার দিকে এ তথ্য নিশ্চিত করেন।
জালাল উদ্দিন বলেন, এমপি আনারকে খুনের উদ্দেশ্যে অপহরণের মামলায় স্বেচ্ছায় জবানবন্দি দিতে সম্মত হওয়ায় সোমবার দুপুর ৩টার দিকে জবানবন্দি দেওয়া শুরু করেন শিলাস্তি। মাঝে আদালত বিচারিক অন্য কাজ করে আবার জবানবন্দি নেওয়া শুরু করেন। রাত সোয়া ৯টার দিকে জবানবন্দি রেকর্ড শেষ হয়। এরপর শিলাস্তিকে কারাগারে পাঠানো হয়।
জানা গেছে, রিমান্ড চলাকালে শিলাস্তি স্বেচ্ছায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিতে সম্মত হওয়ায় তা রেকর্ড করার আবেদন করেন তদন্ত কর্মকর্তা গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সহকারী কমিশনার মাহফুজুর রহমান। তার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকার অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট তোফাজ্জল হোসেনের আদালত শিলাস্তির জবানবন্দি রেকর্ড করেন।
আদালতের একটি সূত্র জানায়, জবানবন্দিতে শিলাস্তি রহমান নিউটাউনের সঞ্জীবা গার্ডেনের ঐ ফ্ল্যাটে ওঠার কথা স্বীকার করেছেন। ফ্ল্যাট ভাড়া নেওয়ার নথিপত্রে তাকে আক্তারুজ্জামান শাহীনের স্ত্রী হিসেবে পরিচয় দেওয়া হয়। সঞ্জীবা গার্ডেনের ঐ ফ্ল্যাটটি ছিল ট্রিপলেক্স। ঘটনার দিন তিনি জানতেন যে ঐ ফ্ল্যাটে ঝিনাইদহের এমপি আনার আসবেন। তাকে ‘খুশি করার’ কথা ছিল তার। বিভিন্ন সময়ে তাকে এ ধরনের কাজ করতে হয়। তবে তিন তলা ফ্ল্যাটের যে ফ্লোরে তিনি ঢুকেছিলেন, ঐ ফ্লোরে এমপি আনার আসেননি। তাই তাকে কারা হত্যা করেছে বা লাশ কীভাবে গুম করেছে-এ বিষয়ে তিনি কিছুই জানেন না।
ঢাকার আরেকটি আদালত এই মামলার প্রধান আসামি মো. আক্তারুজ্জামানসহ ১০ জনের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট অনুসন্ধানের জন্য তথ্য চেয়ে আদালতে আবেদন করেছে ডিবি পুলিশ। সংশ্লিষ্ট আদালতের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) তাপস কুমার পাল এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান, ১০ জনের ব্যাংক হিসাবের তথ্য সরবরাহ করার আদেশ চেয়ে আদালতে আবেদন করেছিল পুলিশ। আদালত সেই আবেদন মঞ্জুর করেন। ফলে বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট এসব ব্যাংক হিসাবে লেনদেনের তথ্য মামলার তদন্তকারী সংস্থা গোয়েন্দা পুলিশকে (ডিবি) সরবরাহ করবে।
শিলাস্তি রহমান ছাড়া এই মামলায় ঢাকায় গ্রেপ্তার অপর আসামিরা হলেন- সৈয়দ আমানুল্লাহ (প্রকৃত নাম শিমুল ভূঁইয়া) ও ফয়সাল আলী। তারা দুজন বর্তমানে পুলিশ হেফাজতে আছেন।
এদিকে এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত ও নেপালে গ্রেফতার আরেক আসামি সিয়াম হোসেনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির আদেশ দিয়েছে আদালত। পুলিশের করা আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সোমবার আদালত পরোয়ানা জারি করে। তবে নেপালে গ্রেফতার সিয়ামকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনতে চাইলেও সেটি সম্ভব হয়নি। নেপালের ইন্টারপোল শাখা পুলিশ তাকে ভারতীয় পুলিশের কাছে হস্তান্তর করেছে।
গতকাল শেরেবাংলা নগর থানার আদালতের সাধারণ নিবন্ধন শাখার উপ-পরিদর্শক জালাল উদ্দিন বলেন, রবিবার (২ জুন) মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবি পুলিশের সহকারী পুলিশ কমিশনার মাহফুজুর রহমানের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এমপি আনার হত্যাকাণ্ডে জড়িত ও নেপালে গ্রেফতার সিয়াম হোসেনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির আদেশ দিয়েছে আদালত।
আনার অপহরণ মামলায় ১০ আসামির ব্যাংক হিসাব তদন্তের নির্দেশ : এমপি আনার অপহরণ মামলায় গ্রেফতার ও পলাতক ১০ আসামির ব্যাংক অ্যাকাউন্টের তথ্য চেয়ে আদালতে আবেদন করেছে ডিবি পুলিশ। ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতে এ আবেদন করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সহকারী কমিশনার মাহফুজুর রহমান।
আসামিরা হলেন- শিমুল ভূইয়া, শিলাস্তি রহমান, তানভীর ভূঁইয়া, আক্তারুজ্জামান শাহীন, সিয়াম হোসেন, মোস্তাফিজুর রহমান, ফয়সাল আলা সাজী, চেলসি চেরী, তাজ মোহাম্মদ খান ও জামাল হোসেন।
আবেদনে গোয়েন্দা পুলিশ উল্লেখ করে, মামলার মূল রহস্য উদঘাটন ও সুষ্ঠ তদন্তের স্বার্থে গ্রেফতার হওয়া ও পলাতক আসামিদের এনআইডি ও পাসপোর্ট নম্বরের বিপরীতে কোন ব্যাংকে কয়টি অ্যাকাউন্ট আছে, তার তথ্য সরবরাহের জন্য হেড অব বাংলাদেশ, এফআইইউ (বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট) বরাবর আদেশ প্রদান করতে আদালতের কাছে অনুমতি চাওয়া হয়। শুনানি শেষে আদালত ডিবির আবেদনটি মঞ্জুর করে। সংশ্লিষ্ট আদালতের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর তাপস কুমার পাল বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
নেপালে গ্রেফতার সিয়ামকে ভারতীয় পুলিশের কাছে হস্তান্তর : নেপালে গ্রেফতার সিয়ামকে সোমবার ভারতীয় পুলিশের কাছে হস্তান্তর করেছে নেপাল ইন্টারপোল শাখা পুলিশ। বৃহস্পতিবার (৩০ মে) তাকে গ্রেফতার করে নেপাল পুলিশ। তাকে গ্রেফতারের তথ্য জানানোর পর শনিবার (১ জুন) সে দেশে যায় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের প্রধান মোহাম্মদ হারুন অর রশীদের নেতৃত্বাধীন চার সদস্যের একটি দল। পশ্চিমবঙ্গ সিআইডির একটি টিমও নেপাল যায়। নেপাল থেকে সিয়ামকে বাংলাদেশ ও ভারতের টিম পৃথকভাবে নিজ নিজ দেশে ফিরিয়ে আনতে চায়। তবে নেপাল পুলিশ (ইন্টারপোল শাখা) সিয়ামকে ভারতীয় টিমের কাছে হস্তান্তর করলেও কবে নাগাদ তাকে কলকাতার নিউটাউনের বরাহনগর থানায় আনা হবে, সেটি নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
পশ্চিমবঙ্গের বাগজোলা খালে নৌসেনার তল্লাশি : এমপি আনারের দেহাবশেষের খোঁজে পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ ২৪ পরগনার ভাঙড় এলাকার বাগজোলা খালে তল্লাশি চালিয়েছে ভারতীয় নৌসেনার তিন সদস্যের একটি টিম। বিশাখাপত্তমের নৌসেনা ইউনিট থেকে এই তিন জনের প্রতিনিধিদল সেখানে আসে। সোমবার দুপুর থেকে তারা এবং পশ্চিমবঙ্গ সিআইডির একটি দল ঐ খালে যৌথ তল্লাশি অভিযান চালায়। তবে দীর্ঘ পাঁচ ঘণ্টার তল্লাশি অভিযানে কিছুই পাওয়া যায়নি।
ইতিমধ্যে নিউ টাউনের সঞ্জীবা গার্ডেনের ফ্ল্যাটের সেপটিক ট্যাংক থেকে উদ্ধার করা মাংসপিণ্ড সদৃশ বস্তুগুলো ফরেনসিক পরীক্ষার জন্য কলকাতা সিআইডির ফরেনসিক ল্যাবে পাঠানো হয়েছে। পাশাপাশি ডিএনএ পরীক্ষারও প্রস্তুতি শুরু করেছে। চলতি সপ্তাহে ডিএনএ পরীক্ষার রিপোর্ট পাওয়া যাবে।
উল্লেখ্য- গত ২২ মে রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানায় এই মামলাটি করেন এমপি আনারের মেয়ে মুমতারিন ফেরদৌস ডরিন। মামলার অভিযোগে তিনি উল্লেখ করেছেন, রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউর বাসায় আমরা সপরিবারে বসবাস করি। আমার বাবা আনোয়ারুল আজীম আনার গত ৯ মে রাত ৮টার দিকে গ্রামের বাড়ি ঝিনাইদহ যাওয়ার উদ্দেশে যাত্রা করেন। ১১ মে বিকেল পৌনে ৫টার দিকে বাবার সঙ্গে ভিডিওকলে কথা বললে বাবার কথাবার্তা কিছুটা অসংলগ্ন মনে হয়। এরপর বাবার মোবাইল নম্বরে একাধিকবার কল দিলেও বন্ধ পাই।
১৩ মে বাবার ভারতীয় নম্বর থেকে উজির মামার হোয়াটসঅ্যাপে একটি খুদে বার্তা আসে। এতে লেখা ছিল, ‘আমি হঠাৎ করে দিল্লি যাচ্ছি, আমার সঙ্গে ভিআইপি রয়েছে। আমি অমিত শাহের কাজে নিউ টাউন যাচ্ছি। আমাকে ফোন দেওয়ার দরকার নাই। আমি পরে ফোন দেব।’ এ ছাড়া আরও কয়েকটি বার্তা আসে। খুদে বার্তাগুলো আমার বাবার মোবাইল ফোন ব্যবহার করে অপহরণকারীরা করে থাকতে পারে। বিভিন্ন জায়গায় বাবার খোঁজ করতে থাকি। কোনো সন্ধান না পেয়ে তার বন্ধু গোপাল বিশ্বাস বাদী হয়ে ভারতীয় বারানগর পুলিশ স্টেশনে সাধারণ ডায়েরি করেন। এর পরও আমরা খোঁজাখুজি অব্যাহত রাখি। পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জানতে পারি অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিরা পূর্বপরিকল্পিতভাবে পরস্পর যোগসাজশে বাবাকে অপহরণ করেছে।
প্রসঙ্গত- এমপি আনার ভারতে খুন হয়েছেন বলে দেশটির গণমাধ্যমে এরই মধ্যে পুলিশের বরাত দিয়ে খবর প্রকাশিত হয়েছে। এই ঘটনায় সেখানে বর্তমানে একটি হত্যা মামলা বিচারাধীন আছে।