সিনিয়র স্টাফ রিপোর্টার

প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা বলেছেন, আমরা তিস্তা প্রকল্প নিয়েছি। প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য চীন ও ভারত আলাদা আলাদা প্রস্তাব দিয়েছে। আরও প্রস্তাব এসেছে।
অবশ্যই আমরা বিবেচনা করবো, কোন প্রস্তাবটি গ্রহণ করলে তা আমার দেশের মানুষের কল্যাণে আসবে সেটাই আমি গ্রহণ করবো। কোন প্রস্তাবটা নিলে কতটুকু ঋণ নিলাম এবং কতটুকু  পরিশোধ করতে হবে, কতটুকু দিতে পারবো-এসব কিছু বিবেচনা করেইতো আমাদের পরিকল্পনা নিতে হবে।

মঙ্গলবার (২৫ জুন) সকাল ১১টার দিকে গণভবনে সাম্প্রতিক দ্বিপাক্ষিক ভারত সফর নিয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে  সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এসব কথা বলেন।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, সেক্ষেত্রে ভারত যেহেতু বলেছে তারা করতে চায় এবং টেকনিক্যাল গ্রুপ বানাবে, তারা অবশ্যই আসবে। আমরা যৌথভাবে সেটা দেখবো। চীন একটা সম্ভাব্যতা যাচাই করেছে। ভারতও একটা করবে। এরপর আমাদের কাছে যেটা সবচেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্য ও লাভজনক মনে হবে আমরা সেটাই করবো। তাছাড়া ভারতের কাছে তিস্তার পানির দাবিটা যেহেতু অনেক দিনের সেক্ষেত্রে ভারত যদি তিস্তা প্রকল্পটি করে দেয় তবে আমাদের সব সমস্যারই সামাধান হয়ে যায়। সেটাই আমাদের জন্য সবচেয়ে সহজ হলো-আপনারা নিজেরাই বিবেচনা করে দেখেন। ভারত যখন এগিয়ে এসেছে আমরা এটাই মনে করি যে ভারতের সাথে যদি আমরা এই তিস্তা প্রকল্প বাস্তবায়ন করি তাহলে আমার দেশের পানি নিয়ে প্রতিদিন সমস্যায় পড়তে হবে না। আমরা সেই সুবিধাটা পাব।

প্রধানমন্ত্রী দেশের জাতির পিতার দিয়ে যাওয়া পররাষ্ট্র নীতি ‘সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব এবং কারো সঙ্গে বৈরিতা নয়,’ এর প্রসঙ্গ টেনে অপর এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, আমিতো এখানে কোন সমস্যা দেখি না। ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদি যখন আমাকে তাঁর শপথ অনুষ্ঠানে যাবার দাওয়াত দিলেন, আমরা গেলাম। তারপর তিনি রাষ্ট্রীয় সফরের দাওয়াত দিলেন, সে সফরও করে আসলাম। চীন আমাকে দাওয়াত দিয়েছে আমি চীনে যাব। আমার বাংলাদেশ সার্বভৌম দেশ এবং সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব নিয়েই আমি চলবো। কার কি সমস্যা সেটা তাদের সঙ্গে থাক আমার নয়, আমার দেশের মানুষের কতটুকু উন্নতি করতে পারি সেটাই আমার লক্ষ্য।

ভারত বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ও নিকটতম প্রতিবেশী, বিশ্বস্ত বন্ধু এবং আঞ্চলিক অংশীদার। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে যে সম্পর্কের সূচনা হয় তাকে বাংলাদেশ সবসময়ই বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে আসছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দুই দেশই রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়সহ উচ্চপর্যায়ের মধ্যে যোগাযোগ ও সহযোগিতা অব্যাহত রেখেছে।

শেখ হাসিনা বলেন, ৫৪টি অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন নিয়ে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের দীর্ঘদিনের সমস্যা রয়েছে। তার সমাধানও আছে। এ সময় গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি ২০২৬ সালের শেষ হবে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যদি চুক্তিটি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নবায়ন নাও করা হয় তাহলেও তা অব্যাহত থাকবে।

তিস্তা ও গঙ্গা নদীর পানি বণ্টনের বিষয়ে ভারত সরকারের পদক্ষেপ নিয়ে মমতা বন্দোপাধ্যায়ের আপত্তি উত্থাপন সংক্রান্ত অপর এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তিনি এই বিষয়ে কোনো মন্তব্য করবেন না। কেননা এটা তাদের (ভারত) অভ্যন্তরীণ বিষয়। কিন্তু ভারতের সকল রাজনৈতিক দল এবং প্রধানমন্ত্রী নেরেন্দ্রে মোদী এবং মূখ্য মন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর সুসম্পর্ক রয়েছে। অন্যান্য সব দলের সঙ্গেও আমার সম্পর্ক ভালো। ভারতের দল মত নির্বিশেষে সবার সঙ্গে আমার একটা সুসম্পর্ক আছে।

বাংলাদেশের ভেতরে দিয়ে ভারতের রেল চলাচলের সুযোগ দেওয়ার নামে দেশকে বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে বলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমালোচনা সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, একটা দেশের মধ্যে অন্য দেশের ট্রানজিট দিলে ক্ষতি কি? রেল যেগুলো বন্ধ ছিল (ভারতের সঙ্গে) সেগুলো আস্তে আস্তে খুলে দিচ্ছি। অর্থনীতিতে এটা বিরাট অবদান রেখে যাচ্ছে। আমরা বাংলাদেশে কী চারদিকে দরজা বন্ধ করে থাকব? ইউরোপের দিকে তাকান সেখানে কোনো বর্ডার নেই। সেখানে কী এক দেশ আরেক দেশের কাছে বিক্রি করে দিচ্ছে?

সরকার প্রধান বলেন, বাংলাদেশ স্বাধীন দেশ। মুক্তিযুদ্ধ করে এ দেশ আমরা স্বাধীন করেছি। যারা সমালোচনা করে তাদের জানা উচিত, একটি মাত্র মিত্র শক্তি আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বুকের রক্ত ঢেলে দিয়ে এ দেশ স্বাধীন করেছে। আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা সেখানে ট্রেনিং পেয়েছে। পৃথিবীতে যারা মিত্র শক্তি, যারা যুদ্ধে সহযোগিতা করে, তারা কিন্তু ওই দেশ ছেড়ে কোনদিন ফেরত যায়নি। এখনো জাপানে আমেরিকান সৈন্য, জার্মানিতে রাশিয়ান সৈন্য রয়েছে এবং বিভিন্ন দেশ দেখলে সে দৃষ্টান্ত পাওয়া যাবে। সেখানে ভারত কিন্তু ব্যতিক্রম।

ভারত মিত্র শক্তি হিসেবে আমাদের পাশে থেকে যুদ্ধ করেছে। কিন্তু, যখনই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান চেয়েছেন তারা (ভারতের সৈন্য) দেশে ফেরত যাক, ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়েছেন এবং তাদের ফেরত নিয়ে গেছেন। এরপরও যারা বলে ভারতের কাছে  দেশ বিক্রি হয়ে যাবে? সে বিক্রিটা হয় কিভাবে? সেটাই আমার প্রশ্ন। আসলে যারা এটা বলে তারা নিজেরাই ভারতের কাছে বিক্রি হয়ে আছে। আমরা দেখেছি, যখনই মিলিটারি ডিক্টেটররা (সামরিক স্বৈরাচার) ক্ষমতায় এসেছে- জিয়া, এরশাদ, খালেদা জিয়া, তারা ওপর দিয়ে ভারত বিরোধী কথা বলেছে, আর ভারতে গিয়ে সেখানে পা ধরে বসে থেকেছে। এগুলো আমার নিজের দেখা, জানা। কাজেই এ ধরনের কথা বলার কোন অর্থ হয় না।

‘ছোট ভূখন্ডের হলেও আমরা স্বাধীন ও স্বার্বভৌম দেশ’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, সেই স্বার্বভৌমত্ব রক্ষা এবং স্বকীয়তা বজায় রেখে এবং বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখেই আমরা কাজ করছি। আজকে আমরা এই যে সব যোগাযোগ ব্যবস্থা সব খুলে দিলাম তাতে সবথেকে বেশি লাভবান হবে আমাদের দেশের মানুষ। তাদের যোগাযোগ করতে হয়, যেতে হয়। চিকিৎসার জন্য যায়, পড়াশোনার জন্য যায়, অন্যান্য কাজে যায়, হাট-বাজার করতে যায়, আজমীর শরিফসহ বিভিন্ন জায়গায় তারা যাতায়াত করে। সেক্ষেত্রে আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রটাওতো আরো উন্মুক্ত হবে। জাতির পিতার কন্যা শেখ হাসিনা এ দেশ বিক্রি করে না। কারণ, আমরা এদেশ স্বাধীন করেছি এটা তাদের মনে রাখা উচিত। আর যে কষ্টটা আমরা ভোগ করেছি সেটা আমরা জানি। যারা বিক্রির কথা বলছে তারা ’৭১ পাকিস্তানের দালালি করেছে বলেও তিনি সন্দেহ ব্যক্ত করেন।

এ সময় ভারতের ভেতর দিয়ে এনার্জি ট্রানজিট তৈরী করে নেপাল ও ভূটান থেকে জলবিদ্যুৎ নিয়ে আসার সরকারের উদ্যোগের জন্য সাংবাদিক সমাজের পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানানো হয়। প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাঁর এ দুটি দ্রুত ও সংক্ষিপ্ত ভারত সফর দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে আরও উন্নত করবে।

প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব মো. নাঈমুল ইসলাম খানের সঞ্চালনায়  সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, দলের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য ও জাতীয় সংসদ উপনেতা বেগম মতিয়া চৌধুরী, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, কাজী জাফরউল্লাহ, দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও পররাষ্ট্র মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান ফজলুর রহমান।

প্রসঙ্গত, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আমন্ত্রণে ২১ ও ২২ জুন নয়াদিল্লি সফর করেন শেখ হাসিনা। লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি নেতৃত্বাধীন জোট টানা তৃতীয়বারের মতো সরকার গঠন করার পর ভারতে কোনো সরকার প্রধানের এটিই প্রথম দ্বিপাক্ষিক সফর। এই সফরটি ছিল ১৫ দিনেরও কম সময়ের মধ্যে ভারতের রাজধানীতে শেখ হাসিনার দ্বিতীয় সফর। গত ৯ জুন মোদির শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত বিশিষ্ট জনদের মধ্যে তিনি উপস্থিত ছিলেন।