সিনিয়র রিপোর্টার
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ৫ আগস্ট পদত্যাগ করে ভারতে চলে যান। তারপর পুলিশ জনগণের আক্রোশের শিকার হয়। ওইদিন থেকে শুরু করে কিছুটা সময় পুলিশ সদস্যরা আত্মগোপনে চলে যান। এই সুযোগে ওই সময়টিতে দেশের বিভিন্ন থানা, ফাঁড়ি ও পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটে হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ করে উত্তেজিত জনতা। লুট হয় পুলিশের কয়েক হাজার অস্ত্র ও গোলাবারুদ।
সর্বশেষ সোমবার (১৯ আগস্ট) পর্যন্ত পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য মতে লুট হওয়া ৮২৬টি অস্ত্র, ২০ হাজার ৭৭৮ রাউন্ড গুলি, এক হাজার ৪৮২টি টিয়ার গ্যাস শেল ও ৭১টি সাউন্ড গ্রেনেড উদ্ধার করা হয়েছে। অভিযান এখনও চলমান।
পুলিশের পক্ষ থেকে অস্ত্র-গুলি ফিরিয়ে দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে পুলিশ সদর দপ্তর জানায়, অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার চলছে। কারো কাছে অবৈধ অস্ত্র থাকলে নিকটস্থ থানায় জমা দেওয়ার জন্য অনুরোধ জানানো হয়। এছাড়া সারাদেশে বিভিন্ন থানা থেকে লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধারে সহায়তা করছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। সোমবার গাজীপুর ও নরসিংদীসহ দেশের একাধিক স্থানে সেনাবাহিনী পুলিশকে অনেক লুটের অস্ত্র উদ্ধার করে ফিরিয়ে দিয়েছে।
এদিকে, সারাদেশে ৬৩৯টি থানার সবগুলোর কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এরইমধ্যে অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, সাধারণ মানুষের হাত থেকে পুলিশের লুট হওয়া এসব অস্ত্র সন্ত্রাসীদের কাছে চলে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে। যদি তাই হয় তবে দেশের নিরাপত্তার জন্য তা হুমকি হবে। দেশের বিভিন্ন কারাগার থেকে আসামি পলায়ন এবং থানা-ফাঁড়িতে হামলা করে অস্ত্র লুট নিরাপত্তার জন্য মারাত্মক ঝুঁকি। তবে ঠিক কত সংখ্যক অস্ত্র-গোলাবারুদ লুট হয়েছে সে পরিসংখ্যান দেয়নি পুলিশ।
অপরাধ বিশেষজ্ঞদের দাবি, শিগগির অস্ত্র উদ্ধারে বিশেষ অভিযান শুরু করা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে যৌথ অভিযান শুরু করতে পারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। অন্যথায় দেশে খুন, ডাকাতি, অপহরণ, চুরি ও ধর্ষণের মতো বিভিন্ন অপরাধ বেড়ে যেতে পারে।
ফেনী মডেল থানা থেকে লুট হওয়া একটি পিস্তল বিক্রির সময় ধরা পড়েন মোহাম্মদ রুবেল (২৯) নামে এক যুবক। এ সময় পিস্তলটি উদ্ধার করে পুলিশ। ফেনী মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রুহুল আমিন বলেন, গত ১৪ আগস্ট রাতে ফেনী শহরের শাহীন একাডেমি এলাকায় এক ক্রেতার সঙ্গে দরকষাকষির সময় পিস্তলসহ পুলিশের হাতে ধরা পড়েন রুবেল। শুধু একটি নাইন এমএম পিস্তল নয়, রুবেলের কাছ থেকে ১৪ রাউন্ড গুলি ও দুটি ম্যাগজিন উদ্ধার করা হয়।
সিরাজগঞ্জের হাটিকুমরুল থানা থেকে লুট হওয়া অস্ত্র জমা দিয়েছেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। লুট হওয়া অস্ত্রগুলোর মধ্যে একটি গ্যাসগান, চায়না রাইফেল, সিগন্যাল লাইট ও শোল্ডার সিগন্যাল লাইট ছিল।
সলঙ্গা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এনামুল হক বলেন, ছাত্র আন্দোলনের সময় হাটিকুমরুল হাইওয়ে থানায় আন্দোলনকারীরা আক্রমণ করে। ওই সময় কয়েকটি অস্ত্র লুটের ঘটনাও ঘটে। অস্ত্রগুলোর মধ্যে দুটি রাস্তায় ভেঙে ফেলেন তারা। সেগুলো কুড়িয়ে নিয়ে কয়েকজন হাটিকুমরুল ইউনিয়নের পাঁচলিয়া এলাকার ইউপি সদস্য শাহ আলীর কাছে জমা রাখেন। অস্ত্রগুলো ইউপি সদস্য ও আন্দোলনে যুক্ত কামরুল হাসান এবং নাজমুল হাসানসহ কয়েকজন ছাত্র সলঙ্গা থানায় জমা দেন।
ফরিদপুরের সদরপুর থানা থেকে লুট করা অস্ত্র নিয়ে তিন বন্ধু টিকটক ভিডিও করতে গিয়ে ‘অসাবধানতাবশত’ গত ৬ আগস্ট গুলিবিদ্ধ হয়ে পলাশ হোসেন (১৮) নামে এক যুবকের মৃত্যু হয়। গত ১২ আগস্ট ঢাকা নিউরো সায়েন্স হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান পলাশ।
গত ৯ আগস্ট আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন থানা ও কারাগার থেকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ লুটপাটের কিছু ঘটনা ঘটে। এক্ষেত্রে কারো কাছে রক্ষিত এ ধরনের অস্ত্র ও গোলাবারুদ অথবা এ সংক্রান্ত কোনো তথ্য থাকলে দ্রুত নিকটস্থ সেনাক্যাম্পে জমা অথবা যোগাযোগ করার জন্য অনুরোধ করা হলো। সোমবার পুলিশ সদর দপ্তরও একই ধরনের আহ্বান জানায়।
সাবেক আইজিপি নুরুল হুদা বলেন, বেআইনি লোকদের কাছে কিংবা লাইসেন্স ছাড়া অস্ত্র থাকা বিপজ্জনক। তাদের জন্য ও সমাজের জন্য বিপজ্জনক। এগুলো দ্রুত উদ্ধার করা দরকার।
সাবেক আইজিপি নুর মোহাম্মদ বলেন, লাইসেন্সবিহীন অস্ত্র অন্যদের হাতে থাকা নিরাপত্তার জন্য হুমকি। অনেকেই খেলার ছলে কিংবা রাগের জন্য অস্ত্র নিয়ে গেছে। তারা হয়তো ফেরত দেবে। এরপর দেখতে হবে কোন ইউনিট থেকে কতগুলো অস্ত্র এখনো উদ্ধার হয়নি। পুলিশের কিছু সোর্স আছে, সেসব সোর্স মেনটেইন করে তথ্য নিতে হবে। যাচাই-বাছাইয়ের পর অস্ত্র উদ্ধারে বিশেষ অভিযান করতে হবে।
র্যাব সদর দপ্তরের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের সিনিয়র সহকারী পরিচালক আ ন ম ইমরান খান বলেন, সম্প্রতি বাংলাদেশে পুলিশের বিভিন্ন থানা, ফাঁড়ি ও পুলিশ লাইনস থেকে লুট করা অস্ত্র ও গোলাবারুদ স্বেচ্ছায় নিকটস্থ র্যাব কার্যালয়-ব্যাটালিয়নে ফেরত দিতে অনুরোধ জানানো হয়েছে।
জানতে চাইলে পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) ইনামুল হক সাগর বলেন, দেশের বিভিন্ন থানা, ফাঁড়ি ও পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটে হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ এবং অস্ত্র ও গোলাবারুদ লুট হয়েছে। উদ্ধার কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। নিকটস্থ থানায় অস্ত্র জমা দেওয়ার জন্য অনুরোধ জানিয়েছি আমরা।
সোমবারের মধ্যে অস্ত্র জমা না দিলে অস্ত্র উদ্ধার অভিযান শুরু হবে বলে জানিয়েছিলেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন। তিনি বলেন, গত ১৯ আগস্টের পর কারো কাছে অস্ত্র পাওয়া গেলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। যদি জমা না দেন তাহলে দুটি অপরাধ গণ্য হবে। একটি অবৈধ অস্ত্র, আরেকটি সরকারি নিষিদ্ধ অস্ত্র আপনাদের হাতে। আন্তর্জাতিক আদালতেও মামলা যেতে পারে।