ঢাকা , বৃহস্পতিবার, ১০ অক্টোবর ২০২৪, ২৫ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

জলবায়ু পরিবর্তন : ধনীদের বিলাসিতায় ভুগছে গরীব দেশ

  • ডেস্ক :
  • আপডেট সময় ০৭:১৩ অপরাহ্ন, বুধবার, ৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪
  • 37

সোহেলী চৌধুরী

পৃথিবী-প্রকৃতি বদলে যাচ্ছে। কোনোকিছুই ঠিকভাবে ধরা দিচ্ছে না। বাড়ছে প্রযুক্তির ব্যবহার। ফুঁসে উঠছে প্রকৃতি। বাড়ছে প্রাণের সংহার। বাড়ছে সমুদ্রপৃষ্টের উচ্চতা। এতে অনেক নিচু দেশ ক্রমশ হারিয়ে যাওয়ার শঙ্কা জাগছে। গলে যাচ্ছে মেরুর বরফ। এতে বাংলাদেশের মতো দেশগুলোতে নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা যাচ্ছে। ধনী দেশগুলো দেদার কার্বন নিঃসরণ করছে। তবু তাদের বিলাসিতা কমছে না। এদিকে ধুঁকে যাচ্ছে গরীব দেশগুলো। জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা ভয়ংকর সতর্কবার্তা দিচ্ছেন। ইত্যকার যা দেখার নয় তাই দেখছি আমরা।

বন্যা, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, খরা, নদী ভাঙন এসবই জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়ানক ফসল। এতে করে বিশ্বব্যাপী বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যাও বাড়ছে। শহরগুলোতে নাগরিক চাপ বাড়ছে। জলবায়ুর পরিবর্তিত রূপ ক্রমান্বয়ে মানব সভ্যতার অস্তিত্বের জন্য এক বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এটি এমন একটি সমস্যা, যা দেশ, জাতি, উপমহাদেশ কিংবা মহাদেশ কোনো কিছুর সীমানা মেনে চলে না।

বলা প্রয়োজন, কোনো জায়গার গড় জলবায়ুর দীর্ঘমেয়াদি ও অর্থপূর্ণ পরিবর্তন; যার ব্যাপ্তি কয়েক যুগ থেকে কয়েক লাখ বছর পর্যন্ত হতে পারে, তাকে জলবায়ু পরিবর্তন বলে। এ পরিবর্তন বিভিন্ন নিয়ামকের ওপর নির্ভরশীল। পৃথিবীর আহরণকৃত সৌরবিকিরণের পরিবর্তন, ভূত্বক গঠনের পাততত্ত্ব, আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত প্রভৃতির ওপর। বর্তমানে সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও বিশ্বায়নের দৃষ্টিকোণ থেকে জলবায়ু পরিবর্তন বললে সমগ্র পৃথিবীর সাম্প্রতিক সময়ের মানুষের কর্মকাণ্ডের কারণে জলবায়ুর পরিবর্তনকে বোঝায়; যা ভূমণ্ডলীয় উষ্ণতা বৃদ্ধিরই রূপান্তর। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের বিভিন্ন গ্যাস, জলীয়বাষ্প ও অপরাপর উপাদানের মধ্যে প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় থাকলেও ঊনবিংশ শতকের শুরু থেকে বায়ুমণ্ডলে অতিমাত্রায় ওজোন গ্যাস ক্লোরোফ্লোরোকার্বন তথা সিএফসি যুক্ত হওয়ায় বায়ুমণ্ডলের স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারে অবস্থিত আর্কটিক ওজোনস্তর ফুটো হয়ে গেছে। পরিণামে ওজোনের পাতলা গ্যাসের স্তর পেরিয়ে সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি পরিবেশের ওপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এ ওজোনস্তরই অতিবেগুনি রশ্মিকে ফিল্টারের মতো সযত্নে ছেঁকে নিয়ে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে।

উত্তর গোলার্ধে এ ওজোনস্তরের ফুটো বেশি দৃশ্যমান। তাই সেখানে ক্ষতির পরিমাণও বেশি। পৃথিবীর তিন ভাগই হচ্ছে পানি। আবার এর বড় অংশ হলো বরফ এবং হিমবাহ। উত্তর ও দক্ষিণ গোলার্ধের বরফ, দক্ষিণ মেরুর তুষার আস্তরণ প্রাকৃতিক নিয়মে চললেও শিল্প বিপ্লবের প্রভাবে মানবসভ্যতার উন্মেষের কারণে ভূপৃষ্ঠের উষ্ণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে মেরু অঞ্চলের বরফ দ্রুতই গলছে। এ বরফগলা পানির কারণে সমুদ্রস্ফীতি পরিলক্ষিত হচ্ছে। আর এতে করে পরিবেশ-প্রতিবেশগত বিপর্যয় নেমে আসবে। ফলে দ্বীপদেশ, উপকূলীয় ও নিম্নাঞ্চলের দেশ সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে সমুদ্রে তলিয়ে যাবে।

বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি মূলত গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণের ফলে ঘটছে, যা মূলত শিল্পোন্নত দেশগুলোর কারণে সৃষ্ট। তবে এর প্রভাব বাংলাদেশসহ পৃথিবীর সব দেশেই পড়ছে এবং তা ক্রমেই গুরুতর হয়ে উঠছে। এই তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে আরো উদ্বেগজনক হয়ে উঠেছে। দেশটির সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে নিম্ন অবস্থান এবং জলবায়ুগত বৈচিত্র্যের কারণে তাপমাত্রা বৃদ্ধি সরাসরি বিভিন্ন পরিবেশগত এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলছে। তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে জলাশয়ে পানির স্তর কমে যাচ্ছে এবং মিঠা পানির সরবরাহ হ্রাস পাচ্ছে, যা কৃষির জন্য ব্যবহারযোগ্য পানি কমিয়ে দিচ্ছে। ফলে দেশের কৃষি ব্যবস্থা বড় ধরনের ঝুঁকির মুখে পড়েছে।

এদিকে জলবায়ু পরিবর্তন রোধে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমিয়ে ২০৩০ সালের মধ্যে বার্ষিক কার্বন নির্গমন ৫০ শতাংশ কমানোর যে প্রতিশ্রুতি উন্নত বিশ্বের সরকারগুলো প্যারিস চুক্তিতে করেছিল; আজ এই ২০২৪ সালে দাঁড়িয়ে মনে হয়, সেই প্রতিশ্রুতি পূরণে তারা ব্যর্থ হবে। উপরন্তু গত এক দশকে বায়ুমণ্ডলে কার্বন নির্গমনের হার বেড়েছে। কার্বনসৃষ্ট গ্রিনহাউস গ্যাস বায়ুমণ্ডলকে এতটাই উত্তপ্ত করছে যে, বিজ্ঞানীরা আগামী কয়েক দশকে বৈশ্বিক তাপমাত্রা তিন ডিগ্রি সেলসিয়াসের মতো বেড়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন। এই ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রার ফলে গ্রীষ্মকালে ফসলের চাষাবাদ বা স্বাভাবিক কাজকর্ম করা মানুষের কাছে অসহনীয় হয়ে উঠবে।
পৃথিবীর ৬০টির বেশি দেশের ২ হাজার ৫০০ বিজ্ঞানী মত প্রকাশ করেন, মানবসৃষ্ট গ্রিনহাউস গ্যাসই পৃথিবীর তাপমাত্রা দ্রুততম সময়ে বৃদ্ধির কারণ।

বায়ুমণ্ডলে বিভিন্ন গ্যাসীয় উপাদান তথা নাইট্রোজেন, অক্সিজেন, কার্বন ডাই অক্সাইড, আর্গন ও জলীয়বাষ্প বিদ্যমান। কিন্তু মানবসৃষ্ট বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের কারণে যোগ হওয়া বিভিন্ন গ্যাসের কারণে এ প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। ফলে পৃথিবীর উষ্ণতা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। যানবাহন, রান্নাবান্না, বিদ্যুৎ উৎপাদন ও কলকারখানায় ব্যাপকহারে জীবাশ্ম জ্বালানি তথা কয়লা, পিট, পেট্রোলিয়াম, প্রাকৃতিক গ্যাস প্রভৃতি ব্যবহৃত হয়। বিগত ২০০ বছর ধরে পশ্চিমা দেশগুলোতে অধিকমাত্রায় জ্বালানি ব্যবহারের কারণে এবং বর্তমানে তৃতীয় বিশ্বে যত শিল্পায়ন হচ্ছে তত বেশি কার্বন ডাই অক্সাইড গ্যাস বায়ুমণ্ডলে যুক্ত হচ্ছে।

বিজ্ঞানীদের মতে, বিগত ২০০ বছরে ব্যাপকহারে বন উজাড় এবং জ্বালানি হিসেবে খনিজ তেল ব্যবহারের ফলে বায়ুমন্ডলে কার্বন ডাই অক্সাইড গ্যাস বেড়েছে তিন গুণ। পৃথিবীর তিন-চতুর্থাংশের বেশি কার্বন ডাই অক্সাইড গ্যাস জ্বালানি তেল উৎপাদন ও ব্যবহারের ফলে তৈরি হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণ শুধু অতিরিক্ত কার্বন নির্গমনই নয়, কার্বন শোষণে মূল্যবান সম্পদ সমগ্র বিশ্বের বনাঞ্চল ও রেইনফরেস্টের নির্বিচার উৎপাটনও। কলকারখানা স্থাপন, বনজঙ্গল ও জলাভূমি উজাড় করে বসতি স্থাপন, নদীনালায় তীব্র দূষণ, কৃত্রিম বাঁধ নির্মাণ, জীববৈচিত্র্য ধ্বংস, তীব্র বায়ুদূষণ, ইকোসিস্টেমের বিনাশ প্রভৃতি কারণে স্থানিক, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে পৃথিবী মারাত্মক হুমকির মুখে পতিত হচ্ছে।

আইপিসিসির (ইন্টারগভার্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ) মতে, উন্নয়নের ধারায় কোনো ইতিবাচক পরিবর্তনও যদি সাধিত হয়, তাহলেও আগামী শতকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত যে পরিমাণ কার্বন ডাই অক্সাইড বায়ুমণ্ডলে সঞ্চিত হবে, তার পরিমাণ হবে শিল্প বিপ্লবের আগের মাত্রার দ্বিগুণের বেশি। বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ দ্বিগুণ হলে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা এক দশমিক পাঁচ থেকে চার দশমিক পাঁচ ডিগ্রি পর্যন্ত বাড়বে। বিশ্বব্যাপী বর্তমান নির্গমনের পরিমাণ ২১০০ সাল নাগাদ বায়ুমন্ডলে কার্বন ডাই অক্সাইডের স্থিতাবস্থা আনতে পারবে না।

বিজ্ঞানীদের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০৫০ সাল নাগাদ বিশ্বের বেশ কয়েকটি জায়গায় বড় মাপের জলোচ্ছ্বাস হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। বন্যায় ক্ষতির মাত্রা দুই থেকে তিন গুণ বৃদ্ধি পেতে পারে। সাগর-মহাসাগরের উষ্ণতা ১৯৭০ সাল থেকে বাড়ছে অব্যাহতভাবে। পরিবেশে যে বাড়তি তাপ তৈরি হচ্ছে, তার ৯০ ভাগই সমুদ্র শুষে নিচ্ছে। ১৯৯৩ সাল থেকে শুষে নেওয়ার এ মাত্রা দুই গুণ বেড়েছে। ফলে গ্রিনল্যান্ড ও অ্যান্টার্কটিকার বরফ গলছে। ২০০৭ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত অ্যান্টার্কটিকার বরফ যে হারে গলছে, তা আগের ১০ বছরের তুলনায় তিন গুণ। আশঙ্কা করা হচ্ছে অ্যান্ডিজ, মধ্য ইউরোপ এবং উত্তর এশিয়ার যেসব হিমবাহ রয়েছে, সেগুলোর বরফ ২১০০ সাল নাগাদ ৮০ শতাংশ গলে যাবে। সম্প্রতি জাতিসংঘ রেড অ্যালার্ট জারি করেছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা এমনভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে যে, কোপেনহেগেন ও প্যারিস চুক্তিতে পৃথিবীর তাপমাত্রা সীমিত রাখার যে লক্ষ্যমাত্রা ঘোষিত হয়েছিল তাতে আর কাজ হচ্ছে না। ২০১৫ সালে প্যারিসে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলনে (কপ-২১) ২০৩০ সাল নাগাদ বৈশ্বিক তাপমাত্রা দুই ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং গ্রিন হাউস নির্গমন হ্রাস করে ২০৫০ সালের মধ্যে তাপমাত্রা এক দশমিক পাঁচ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে সীমাবদ্ধ রাখার অঙ্গীকার করা হয়। এছাড়া ক্ষতি মোকাবিলায় জলবায়ু তহবিল গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। ধনী ও শিল্পোন্নত দেশগুলো ১০০ মিলিয়ন ডলার সহায়তা করার অঙ্গীকার করেছিল। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়ার মতো উন্নত দেশ অর্থ জমা দেওয়ার বিষয়ে এখনো পিছিয়ে রয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গমন হ্রাসের কথা বলা হলেও শিল্পোন্নত দেশগুলো তা মানছে না।

আইপিসিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিপর্যয়ের ঝুঁকি প্রতিনিয়ত বাড়ছে। এ ঝুঁকি এড়াতে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ও প্রযুক্তিকে কাজে লাগানো যেতে পারে। নতুন এ প্রতিবেদনকে জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তনিও গুতেরেস ‘মানবজাতির টিকে থাকার নির্দেশিকা’ বলে অভিহিত করেছেন। যত দ্রুত আমরা জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার হ্রাস করতে পারব, তত দ্রুত জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে খারাপ প্রভাব এড়াতে পারব।
ফরাসি সমুদ্রবিজ্ঞানী ড. জ্যঁ পিয়েরে গাত্তুসোর মতে, পৃথিবী এখন মহাসংকটে। বিভিন্ন দিক থেকে ঝুঁকি তৈরি হয়েছে এবং এর জন্য আমরাই দায়ী। নিচু জায়গাগুলোতে সাগরের উচ্চতা বাড়ার পরিণতি হবে ব্যাপক। বিশ্বের ৭০ কোটি মানুষ নিচু উপকূলীয় এলাকায় বসবাস করে; যা খুবই উদ্বেগের।

আইপিসিসি প্যানেলের অধ্যাপক ডেরা রবার্টস বলেন, আমরা নজিরবিহীন কিছু আলামত দেখতে পাচ্ছি। আপনি যদি স্থলভাগের খুব ভেতরেও বসবাস করেন, তাহলেও সাগর এবং পরিবেশে তাপমাত্রা বৃদ্ধির ক্ষতিকর প্রভাব থেকে নিরাপদ থাকতে পারবেন না। তবে আশার বাণী হচ্ছে, সমুদ্রের ভবিষ্যৎ এখনো আমাদের হাতে রয়েছে। এর জন্য ২০৩০ সালের মধ্যে কার্বন নির্গমনের মাত্রা এখনকার তুলনায় কমপক্ষে ৪৫ শতাংশ হ্রাস করতে হবে।

আইপিসিসি প্যানেলের চেয়ারম্যান হোসুং লি বলেন, কার্বন নির্গমনের মাত্রা অনেক কমালেও চরম ঝুঁকির মধ্যে থাকা মানুষের জীবন ও জীবিকার ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলা করাটা চ্যালেঞ্জিং হবে। বড় শঙ্কার, ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে বাংলাদেশ সবসময়ই দুর্যোগপ্রবণ দেশ। আইপিসিসির ২০১২ সালের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের যে ঋণাত্মক প্রভাব, তা সবচেয়ে বেশি পড়ছে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশসমূহের ওপর। জলবায়ু পরিবর্তন বৈশ্বিক সমস্যা হলেও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বিপন্নতার মাত্রা বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ব্যাপক চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিচ্ছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে বাংলাদেশের নিম্নভূমির একটা বড় অংশ পানিতে তলিয়ে যাবে। ফলে সম্পদের বিপুল ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াও জনগোষ্ঠীর একটা বিরাট অংশ বাস্তুহারা হয়ে পড়বে।

সামুদ্রিক লবণাক্ত পানি বাংলাদেশের আরো গভীরে প্রবেশ করে ব্যাপক এলাকা অনাবাদি করে তুলবে। এতে বাংলাদেশের কৃষি, জনজীবন এবং অর্থনীতি বিধ্বস্ত হবে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ততার বিচারে বিশ্বব্যাপী গবেষকগণ বাংলাদেশকে ‘পোস্টার চাইল্ড’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। বাংলাদেশ থেকে মাত্র শূন্য দশমিক ১৪ শতাংশ গ্রিনহাউস গ্যাসের নির্গমন ঘটে, জলবায়ু পরিবর্তনে যার ভূমিকা নগণ্য। অথচ জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে বেশি কুফল ভোগ করবে বাংলাদেশের মতো দুর্যোগপ্রবণ ও উপকূলীয় অঞ্চলের মতো কতিপয় দেশ।

পরিবেশ বিজ্ঞানীরা বলেছেন, বাংলাদেশের ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে বড় দৃশ্যমান প্রভাব হচ্ছে দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোয় লবণাক্ততা বৃদ্ধি। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ঘনঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যেমন- সাইক্লোন, বন্যা, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, ভূমিধস, নদীভাঙন, উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ততা বৃদ্ধি, ফসলহানি, ভূগর্ভস্থ পানিতে অতিমাত্রায় আর্সেনিকের উপস্থিতি, পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়াসহ বিভিন্ন বিপর্যয়ের মুখে পতিত হবে বাংলাদেশ।

জাতিসংঘের দুর্যোগ ঝুঁকি প্রশমন বিষয়ক দপ্তর (ইউএনডিআরআর) বলছে, ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বজুড়ে দুর্যোগের সংখ্যা দাঁড়াতে পারে বছরে ৫৬০টি; যা দৈনিক গড়ে দুটির কাছাকাছি। বৈশ্বিক জলবায়ু সূচক-২০২১ এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ২০ বছরে বাংলাদেশে ১৮৫টি জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বড় দুর্যোগ আঘাত হেনেছে। এতে ১১ হাজার ৪৫০ জনের প্রাণহানি হয়েছে। আর অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে ৩৭২ কোটি ডলার। বিগত দুই দশক ধরে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বাংলাদেশেও সুস্পষ্ট। ভৌগোলিক কারণে বাংলাদেশ সবসময় দুর্যোগপ্রবণ।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের সর্বাধিক ভুক্তভোগীদের অন্যতম বাংলাদেশ। ভূ-প্রকৃতিগতভাবে বাংলাদেশ সমতল ও নিচু ভূমি এলাকা নিয়ে গঠিত। এ দেশের ৮০ শতাংশের বেশি জমি বন্যাপ্রবণ। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বন্যার ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান প্রথম। বাংলাদেশের প্রায় ৪১ শতাংশ মানুষ জীবিকার জন্য কৃষির ওপর নির্ভরশীল। ভারী বৃষ্টিপাত, জলোচ্ছ্বাস বা দীর্ঘস্থায়ী বন্যা এসব মানুষের ওপর সরাসরি নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

জার্মান ওয়াচ ২০২১-এর গ্লোবাল ক্লাইমেট রিস্ক ইনডেক্সের হিসাব অনুযায়ী, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের প্রতি সাতজনে একজন বাস্তুচ্যুত হয়ে ‘ক্লাইমেট রিফিউজি’তে পরিণত হতে পারে। গবেষণার ফল বলছে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ১৯ দশমিক ছয় ইঞ্চি বা ৫০ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেলে বাংলাদেশ প্রায় ১১ শতাংশ ভূমি হারাতে পারে এবং এ প্রক্রিয়ায় প্রায় এক কোটি ৮০ লাঁখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হতে পারে।

আরেক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সায়েন্টিফিক আমেরিকান বলছে, বাংলাদেশের মোট ভূখণ্ডের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ ভূমি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৫ ফুটেরও কম উচ্চতায় অবস্থান করছে। ২১০০ সালের প্রক্ষেপণ অনুযায়ী, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা যদি পাঁচ থেকে ছয় ফুট বৃদ্ধি পায় তবে বাংলাদেশের প্রায় পাঁচ কোটি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়ে ‘ক্লাইমেট রিফিউজি’তে পরিণত হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র সরকারের ২০১৮ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৫৬ শতাংশ বা প্রায় নয় কোটি মানুষ জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকিতে রয়েছে।

গবেষণায় দেখা গেছে, ২০৫০ সালের মধ্যে দেশের প্রায় ১৭ শতাংশ ভূমি সমুদ্রপৃষ্ঠের নিচে চলে যেতে পারে, যার ফলে প্রায় ২০ মিলিয়ন মানুষ বাস্তুচ্যুত হতে পারে। এই বাস্তুচ্যুত মানুষদের একটি বড় অংশ শহরমুখী হবে, যা শহরের ওপর বিশাল চাপ সৃষ্টি করবে। জলবায়ু পরিবর্তনের সমস্যা সমাধানে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। উন্নত দেশগুলোর কাছ থেকে প্রযুক্তি এবং অর্থায়ন সহায়তা পাওয়ার জন্য বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে সম্পর্ক আরো শক্তিশালী করতে হবে। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক জলবায়ু চুক্তিগুলোতে বাংলাদেশের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা প্রয়োজন। প্যারিস চুক্তি ও অন্যান্য বৈশ্বিক উদ্যোগে সক্রিয় অংশগ্রহণ বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যা ত্রিমাত্রিক-অভ্যন্তরীণ, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যার সমাধান করা বাংলাদেশের একার পক্ষে দুঃসাধ্যই বটে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষতি মোকাবিলায় বাংলাদেশ তার ঐকান্তিক প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখুক এবং উন্নয়নশীল ও বিপন্ন দেশগুলোর প্রতিনিধিত্ব করুক; এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

লেখক : সিনিয়র রিপোর্টার- ডেইলি মর্নিং ভয়েস ও কোষাধ্যক্ষ, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন (ডিইউজে)।

ট্যাগস
জনপ্রিয় সংবাদ

তিনদিনের রিমান্ডে এনএস আইয়ের সাবেক পরিচালক কমোডর মনিরুল ইসলাম

জলবায়ু পরিবর্তন : ধনীদের বিলাসিতায় ভুগছে গরীব দেশ

আপডেট সময় ০৭:১৩ অপরাহ্ন, বুধবার, ৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪

সোহেলী চৌধুরী

পৃথিবী-প্রকৃতি বদলে যাচ্ছে। কোনোকিছুই ঠিকভাবে ধরা দিচ্ছে না। বাড়ছে প্রযুক্তির ব্যবহার। ফুঁসে উঠছে প্রকৃতি। বাড়ছে প্রাণের সংহার। বাড়ছে সমুদ্রপৃষ্টের উচ্চতা। এতে অনেক নিচু দেশ ক্রমশ হারিয়ে যাওয়ার শঙ্কা জাগছে। গলে যাচ্ছে মেরুর বরফ। এতে বাংলাদেশের মতো দেশগুলোতে নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা যাচ্ছে। ধনী দেশগুলো দেদার কার্বন নিঃসরণ করছে। তবু তাদের বিলাসিতা কমছে না। এদিকে ধুঁকে যাচ্ছে গরীব দেশগুলো। জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা ভয়ংকর সতর্কবার্তা দিচ্ছেন। ইত্যকার যা দেখার নয় তাই দেখছি আমরা।

বন্যা, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, খরা, নদী ভাঙন এসবই জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়ানক ফসল। এতে করে বিশ্বব্যাপী বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যাও বাড়ছে। শহরগুলোতে নাগরিক চাপ বাড়ছে। জলবায়ুর পরিবর্তিত রূপ ক্রমান্বয়ে মানব সভ্যতার অস্তিত্বের জন্য এক বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এটি এমন একটি সমস্যা, যা দেশ, জাতি, উপমহাদেশ কিংবা মহাদেশ কোনো কিছুর সীমানা মেনে চলে না।

বলা প্রয়োজন, কোনো জায়গার গড় জলবায়ুর দীর্ঘমেয়াদি ও অর্থপূর্ণ পরিবর্তন; যার ব্যাপ্তি কয়েক যুগ থেকে কয়েক লাখ বছর পর্যন্ত হতে পারে, তাকে জলবায়ু পরিবর্তন বলে। এ পরিবর্তন বিভিন্ন নিয়ামকের ওপর নির্ভরশীল। পৃথিবীর আহরণকৃত সৌরবিকিরণের পরিবর্তন, ভূত্বক গঠনের পাততত্ত্ব, আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত প্রভৃতির ওপর। বর্তমানে সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও বিশ্বায়নের দৃষ্টিকোণ থেকে জলবায়ু পরিবর্তন বললে সমগ্র পৃথিবীর সাম্প্রতিক সময়ের মানুষের কর্মকাণ্ডের কারণে জলবায়ুর পরিবর্তনকে বোঝায়; যা ভূমণ্ডলীয় উষ্ণতা বৃদ্ধিরই রূপান্তর। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের বিভিন্ন গ্যাস, জলীয়বাষ্প ও অপরাপর উপাদানের মধ্যে প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় থাকলেও ঊনবিংশ শতকের শুরু থেকে বায়ুমণ্ডলে অতিমাত্রায় ওজোন গ্যাস ক্লোরোফ্লোরোকার্বন তথা সিএফসি যুক্ত হওয়ায় বায়ুমণ্ডলের স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারে অবস্থিত আর্কটিক ওজোনস্তর ফুটো হয়ে গেছে। পরিণামে ওজোনের পাতলা গ্যাসের স্তর পেরিয়ে সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি পরিবেশের ওপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এ ওজোনস্তরই অতিবেগুনি রশ্মিকে ফিল্টারের মতো সযত্নে ছেঁকে নিয়ে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে।

উত্তর গোলার্ধে এ ওজোনস্তরের ফুটো বেশি দৃশ্যমান। তাই সেখানে ক্ষতির পরিমাণও বেশি। পৃথিবীর তিন ভাগই হচ্ছে পানি। আবার এর বড় অংশ হলো বরফ এবং হিমবাহ। উত্তর ও দক্ষিণ গোলার্ধের বরফ, দক্ষিণ মেরুর তুষার আস্তরণ প্রাকৃতিক নিয়মে চললেও শিল্প বিপ্লবের প্রভাবে মানবসভ্যতার উন্মেষের কারণে ভূপৃষ্ঠের উষ্ণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে মেরু অঞ্চলের বরফ দ্রুতই গলছে। এ বরফগলা পানির কারণে সমুদ্রস্ফীতি পরিলক্ষিত হচ্ছে। আর এতে করে পরিবেশ-প্রতিবেশগত বিপর্যয় নেমে আসবে। ফলে দ্বীপদেশ, উপকূলীয় ও নিম্নাঞ্চলের দেশ সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে সমুদ্রে তলিয়ে যাবে।

বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি মূলত গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণের ফলে ঘটছে, যা মূলত শিল্পোন্নত দেশগুলোর কারণে সৃষ্ট। তবে এর প্রভাব বাংলাদেশসহ পৃথিবীর সব দেশেই পড়ছে এবং তা ক্রমেই গুরুতর হয়ে উঠছে। এই তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে আরো উদ্বেগজনক হয়ে উঠেছে। দেশটির সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে নিম্ন অবস্থান এবং জলবায়ুগত বৈচিত্র্যের কারণে তাপমাত্রা বৃদ্ধি সরাসরি বিভিন্ন পরিবেশগত এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলছে। তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে জলাশয়ে পানির স্তর কমে যাচ্ছে এবং মিঠা পানির সরবরাহ হ্রাস পাচ্ছে, যা কৃষির জন্য ব্যবহারযোগ্য পানি কমিয়ে দিচ্ছে। ফলে দেশের কৃষি ব্যবস্থা বড় ধরনের ঝুঁকির মুখে পড়েছে।

এদিকে জলবায়ু পরিবর্তন রোধে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমিয়ে ২০৩০ সালের মধ্যে বার্ষিক কার্বন নির্গমন ৫০ শতাংশ কমানোর যে প্রতিশ্রুতি উন্নত বিশ্বের সরকারগুলো প্যারিস চুক্তিতে করেছিল; আজ এই ২০২৪ সালে দাঁড়িয়ে মনে হয়, সেই প্রতিশ্রুতি পূরণে তারা ব্যর্থ হবে। উপরন্তু গত এক দশকে বায়ুমণ্ডলে কার্বন নির্গমনের হার বেড়েছে। কার্বনসৃষ্ট গ্রিনহাউস গ্যাস বায়ুমণ্ডলকে এতটাই উত্তপ্ত করছে যে, বিজ্ঞানীরা আগামী কয়েক দশকে বৈশ্বিক তাপমাত্রা তিন ডিগ্রি সেলসিয়াসের মতো বেড়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন। এই ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রার ফলে গ্রীষ্মকালে ফসলের চাষাবাদ বা স্বাভাবিক কাজকর্ম করা মানুষের কাছে অসহনীয় হয়ে উঠবে।
পৃথিবীর ৬০টির বেশি দেশের ২ হাজার ৫০০ বিজ্ঞানী মত প্রকাশ করেন, মানবসৃষ্ট গ্রিনহাউস গ্যাসই পৃথিবীর তাপমাত্রা দ্রুততম সময়ে বৃদ্ধির কারণ।

বায়ুমণ্ডলে বিভিন্ন গ্যাসীয় উপাদান তথা নাইট্রোজেন, অক্সিজেন, কার্বন ডাই অক্সাইড, আর্গন ও জলীয়বাষ্প বিদ্যমান। কিন্তু মানবসৃষ্ট বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের কারণে যোগ হওয়া বিভিন্ন গ্যাসের কারণে এ প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। ফলে পৃথিবীর উষ্ণতা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। যানবাহন, রান্নাবান্না, বিদ্যুৎ উৎপাদন ও কলকারখানায় ব্যাপকহারে জীবাশ্ম জ্বালানি তথা কয়লা, পিট, পেট্রোলিয়াম, প্রাকৃতিক গ্যাস প্রভৃতি ব্যবহৃত হয়। বিগত ২০০ বছর ধরে পশ্চিমা দেশগুলোতে অধিকমাত্রায় জ্বালানি ব্যবহারের কারণে এবং বর্তমানে তৃতীয় বিশ্বে যত শিল্পায়ন হচ্ছে তত বেশি কার্বন ডাই অক্সাইড গ্যাস বায়ুমণ্ডলে যুক্ত হচ্ছে।

বিজ্ঞানীদের মতে, বিগত ২০০ বছরে ব্যাপকহারে বন উজাড় এবং জ্বালানি হিসেবে খনিজ তেল ব্যবহারের ফলে বায়ুমন্ডলে কার্বন ডাই অক্সাইড গ্যাস বেড়েছে তিন গুণ। পৃথিবীর তিন-চতুর্থাংশের বেশি কার্বন ডাই অক্সাইড গ্যাস জ্বালানি তেল উৎপাদন ও ব্যবহারের ফলে তৈরি হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণ শুধু অতিরিক্ত কার্বন নির্গমনই নয়, কার্বন শোষণে মূল্যবান সম্পদ সমগ্র বিশ্বের বনাঞ্চল ও রেইনফরেস্টের নির্বিচার উৎপাটনও। কলকারখানা স্থাপন, বনজঙ্গল ও জলাভূমি উজাড় করে বসতি স্থাপন, নদীনালায় তীব্র দূষণ, কৃত্রিম বাঁধ নির্মাণ, জীববৈচিত্র্য ধ্বংস, তীব্র বায়ুদূষণ, ইকোসিস্টেমের বিনাশ প্রভৃতি কারণে স্থানিক, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে পৃথিবী মারাত্মক হুমকির মুখে পতিত হচ্ছে।

আইপিসিসির (ইন্টারগভার্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ) মতে, উন্নয়নের ধারায় কোনো ইতিবাচক পরিবর্তনও যদি সাধিত হয়, তাহলেও আগামী শতকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত যে পরিমাণ কার্বন ডাই অক্সাইড বায়ুমণ্ডলে সঞ্চিত হবে, তার পরিমাণ হবে শিল্প বিপ্লবের আগের মাত্রার দ্বিগুণের বেশি। বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ দ্বিগুণ হলে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা এক দশমিক পাঁচ থেকে চার দশমিক পাঁচ ডিগ্রি পর্যন্ত বাড়বে। বিশ্বব্যাপী বর্তমান নির্গমনের পরিমাণ ২১০০ সাল নাগাদ বায়ুমন্ডলে কার্বন ডাই অক্সাইডের স্থিতাবস্থা আনতে পারবে না।

বিজ্ঞানীদের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০৫০ সাল নাগাদ বিশ্বের বেশ কয়েকটি জায়গায় বড় মাপের জলোচ্ছ্বাস হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। বন্যায় ক্ষতির মাত্রা দুই থেকে তিন গুণ বৃদ্ধি পেতে পারে। সাগর-মহাসাগরের উষ্ণতা ১৯৭০ সাল থেকে বাড়ছে অব্যাহতভাবে। পরিবেশে যে বাড়তি তাপ তৈরি হচ্ছে, তার ৯০ ভাগই সমুদ্র শুষে নিচ্ছে। ১৯৯৩ সাল থেকে শুষে নেওয়ার এ মাত্রা দুই গুণ বেড়েছে। ফলে গ্রিনল্যান্ড ও অ্যান্টার্কটিকার বরফ গলছে। ২০০৭ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত অ্যান্টার্কটিকার বরফ যে হারে গলছে, তা আগের ১০ বছরের তুলনায় তিন গুণ। আশঙ্কা করা হচ্ছে অ্যান্ডিজ, মধ্য ইউরোপ এবং উত্তর এশিয়ার যেসব হিমবাহ রয়েছে, সেগুলোর বরফ ২১০০ সাল নাগাদ ৮০ শতাংশ গলে যাবে। সম্প্রতি জাতিসংঘ রেড অ্যালার্ট জারি করেছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা এমনভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে যে, কোপেনহেগেন ও প্যারিস চুক্তিতে পৃথিবীর তাপমাত্রা সীমিত রাখার যে লক্ষ্যমাত্রা ঘোষিত হয়েছিল তাতে আর কাজ হচ্ছে না। ২০১৫ সালে প্যারিসে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলনে (কপ-২১) ২০৩০ সাল নাগাদ বৈশ্বিক তাপমাত্রা দুই ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং গ্রিন হাউস নির্গমন হ্রাস করে ২০৫০ সালের মধ্যে তাপমাত্রা এক দশমিক পাঁচ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে সীমাবদ্ধ রাখার অঙ্গীকার করা হয়। এছাড়া ক্ষতি মোকাবিলায় জলবায়ু তহবিল গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। ধনী ও শিল্পোন্নত দেশগুলো ১০০ মিলিয়ন ডলার সহায়তা করার অঙ্গীকার করেছিল। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়ার মতো উন্নত দেশ অর্থ জমা দেওয়ার বিষয়ে এখনো পিছিয়ে রয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গমন হ্রাসের কথা বলা হলেও শিল্পোন্নত দেশগুলো তা মানছে না।

আইপিসিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিপর্যয়ের ঝুঁকি প্রতিনিয়ত বাড়ছে। এ ঝুঁকি এড়াতে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ও প্রযুক্তিকে কাজে লাগানো যেতে পারে। নতুন এ প্রতিবেদনকে জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তনিও গুতেরেস ‘মানবজাতির টিকে থাকার নির্দেশিকা’ বলে অভিহিত করেছেন। যত দ্রুত আমরা জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার হ্রাস করতে পারব, তত দ্রুত জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে খারাপ প্রভাব এড়াতে পারব।
ফরাসি সমুদ্রবিজ্ঞানী ড. জ্যঁ পিয়েরে গাত্তুসোর মতে, পৃথিবী এখন মহাসংকটে। বিভিন্ন দিক থেকে ঝুঁকি তৈরি হয়েছে এবং এর জন্য আমরাই দায়ী। নিচু জায়গাগুলোতে সাগরের উচ্চতা বাড়ার পরিণতি হবে ব্যাপক। বিশ্বের ৭০ কোটি মানুষ নিচু উপকূলীয় এলাকায় বসবাস করে; যা খুবই উদ্বেগের।

আইপিসিসি প্যানেলের অধ্যাপক ডেরা রবার্টস বলেন, আমরা নজিরবিহীন কিছু আলামত দেখতে পাচ্ছি। আপনি যদি স্থলভাগের খুব ভেতরেও বসবাস করেন, তাহলেও সাগর এবং পরিবেশে তাপমাত্রা বৃদ্ধির ক্ষতিকর প্রভাব থেকে নিরাপদ থাকতে পারবেন না। তবে আশার বাণী হচ্ছে, সমুদ্রের ভবিষ্যৎ এখনো আমাদের হাতে রয়েছে। এর জন্য ২০৩০ সালের মধ্যে কার্বন নির্গমনের মাত্রা এখনকার তুলনায় কমপক্ষে ৪৫ শতাংশ হ্রাস করতে হবে।

আইপিসিসি প্যানেলের চেয়ারম্যান হোসুং লি বলেন, কার্বন নির্গমনের মাত্রা অনেক কমালেও চরম ঝুঁকির মধ্যে থাকা মানুষের জীবন ও জীবিকার ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলা করাটা চ্যালেঞ্জিং হবে। বড় শঙ্কার, ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে বাংলাদেশ সবসময়ই দুর্যোগপ্রবণ দেশ। আইপিসিসির ২০১২ সালের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের যে ঋণাত্মক প্রভাব, তা সবচেয়ে বেশি পড়ছে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশসমূহের ওপর। জলবায়ু পরিবর্তন বৈশ্বিক সমস্যা হলেও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বিপন্নতার মাত্রা বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ব্যাপক চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিচ্ছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে বাংলাদেশের নিম্নভূমির একটা বড় অংশ পানিতে তলিয়ে যাবে। ফলে সম্পদের বিপুল ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াও জনগোষ্ঠীর একটা বিরাট অংশ বাস্তুহারা হয়ে পড়বে।

সামুদ্রিক লবণাক্ত পানি বাংলাদেশের আরো গভীরে প্রবেশ করে ব্যাপক এলাকা অনাবাদি করে তুলবে। এতে বাংলাদেশের কৃষি, জনজীবন এবং অর্থনীতি বিধ্বস্ত হবে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ততার বিচারে বিশ্বব্যাপী গবেষকগণ বাংলাদেশকে ‘পোস্টার চাইল্ড’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। বাংলাদেশ থেকে মাত্র শূন্য দশমিক ১৪ শতাংশ গ্রিনহাউস গ্যাসের নির্গমন ঘটে, জলবায়ু পরিবর্তনে যার ভূমিকা নগণ্য। অথচ জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে বেশি কুফল ভোগ করবে বাংলাদেশের মতো দুর্যোগপ্রবণ ও উপকূলীয় অঞ্চলের মতো কতিপয় দেশ।

পরিবেশ বিজ্ঞানীরা বলেছেন, বাংলাদেশের ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে বড় দৃশ্যমান প্রভাব হচ্ছে দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোয় লবণাক্ততা বৃদ্ধি। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ঘনঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যেমন- সাইক্লোন, বন্যা, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, ভূমিধস, নদীভাঙন, উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ততা বৃদ্ধি, ফসলহানি, ভূগর্ভস্থ পানিতে অতিমাত্রায় আর্সেনিকের উপস্থিতি, পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়াসহ বিভিন্ন বিপর্যয়ের মুখে পতিত হবে বাংলাদেশ।

জাতিসংঘের দুর্যোগ ঝুঁকি প্রশমন বিষয়ক দপ্তর (ইউএনডিআরআর) বলছে, ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বজুড়ে দুর্যোগের সংখ্যা দাঁড়াতে পারে বছরে ৫৬০টি; যা দৈনিক গড়ে দুটির কাছাকাছি। বৈশ্বিক জলবায়ু সূচক-২০২১ এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ২০ বছরে বাংলাদেশে ১৮৫টি জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বড় দুর্যোগ আঘাত হেনেছে। এতে ১১ হাজার ৪৫০ জনের প্রাণহানি হয়েছে। আর অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে ৩৭২ কোটি ডলার। বিগত দুই দশক ধরে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বাংলাদেশেও সুস্পষ্ট। ভৌগোলিক কারণে বাংলাদেশ সবসময় দুর্যোগপ্রবণ।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের সর্বাধিক ভুক্তভোগীদের অন্যতম বাংলাদেশ। ভূ-প্রকৃতিগতভাবে বাংলাদেশ সমতল ও নিচু ভূমি এলাকা নিয়ে গঠিত। এ দেশের ৮০ শতাংশের বেশি জমি বন্যাপ্রবণ। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বন্যার ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান প্রথম। বাংলাদেশের প্রায় ৪১ শতাংশ মানুষ জীবিকার জন্য কৃষির ওপর নির্ভরশীল। ভারী বৃষ্টিপাত, জলোচ্ছ্বাস বা দীর্ঘস্থায়ী বন্যা এসব মানুষের ওপর সরাসরি নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

জার্মান ওয়াচ ২০২১-এর গ্লোবাল ক্লাইমেট রিস্ক ইনডেক্সের হিসাব অনুযায়ী, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের প্রতি সাতজনে একজন বাস্তুচ্যুত হয়ে ‘ক্লাইমেট রিফিউজি’তে পরিণত হতে পারে। গবেষণার ফল বলছে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ১৯ দশমিক ছয় ইঞ্চি বা ৫০ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেলে বাংলাদেশ প্রায় ১১ শতাংশ ভূমি হারাতে পারে এবং এ প্রক্রিয়ায় প্রায় এক কোটি ৮০ লাঁখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হতে পারে।

আরেক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সায়েন্টিফিক আমেরিকান বলছে, বাংলাদেশের মোট ভূখণ্ডের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ ভূমি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৫ ফুটেরও কম উচ্চতায় অবস্থান করছে। ২১০০ সালের প্রক্ষেপণ অনুযায়ী, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা যদি পাঁচ থেকে ছয় ফুট বৃদ্ধি পায় তবে বাংলাদেশের প্রায় পাঁচ কোটি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়ে ‘ক্লাইমেট রিফিউজি’তে পরিণত হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র সরকারের ২০১৮ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৫৬ শতাংশ বা প্রায় নয় কোটি মানুষ জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকিতে রয়েছে।

গবেষণায় দেখা গেছে, ২০৫০ সালের মধ্যে দেশের প্রায় ১৭ শতাংশ ভূমি সমুদ্রপৃষ্ঠের নিচে চলে যেতে পারে, যার ফলে প্রায় ২০ মিলিয়ন মানুষ বাস্তুচ্যুত হতে পারে। এই বাস্তুচ্যুত মানুষদের একটি বড় অংশ শহরমুখী হবে, যা শহরের ওপর বিশাল চাপ সৃষ্টি করবে। জলবায়ু পরিবর্তনের সমস্যা সমাধানে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। উন্নত দেশগুলোর কাছ থেকে প্রযুক্তি এবং অর্থায়ন সহায়তা পাওয়ার জন্য বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে সম্পর্ক আরো শক্তিশালী করতে হবে। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক জলবায়ু চুক্তিগুলোতে বাংলাদেশের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা প্রয়োজন। প্যারিস চুক্তি ও অন্যান্য বৈশ্বিক উদ্যোগে সক্রিয় অংশগ্রহণ বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যা ত্রিমাত্রিক-অভ্যন্তরীণ, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যার সমাধান করা বাংলাদেশের একার পক্ষে দুঃসাধ্যই বটে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষতি মোকাবিলায় বাংলাদেশ তার ঐকান্তিক প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখুক এবং উন্নয়নশীল ও বিপন্ন দেশগুলোর প্রতিনিধিত্ব করুক; এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

লেখক : সিনিয়র রিপোর্টার- ডেইলি মর্নিং ভয়েস ও কোষাধ্যক্ষ, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন (ডিইউজে)।