ঢাকা , সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

দুদকের অনুসন্ধানের তালিকায় হাসিনা সরকারের উচ্চপদস্থ ৮১ ব্যক্তি

  • ডেস্ক :
  • আপডেট সময় ০৭:০৯ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪
  • 83

সোহেলী চৌধুরী

ক্ষমতায় থাকাকালে আওয়ামী লীগ সরকারের বহু মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যসহ ঘনিষ্ঠ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ থাকলেও তা অনুসন্ধানের কোনো উদ্যোগ নেয়নি দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে সরকার পরিবর্তনের পরই আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী-এমপি এবং সাবেক ও বর্তমান উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের অনিয়ম-দুর্নীতি ও জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের পৃথক অনুসন্ধান শুরু করেছে দুদক।

এদিকে গত ১৫ আগস্ট থেকে শুরু হওয়া দুদকের অনুসন্ধানের তালিকায় এরইমধ্যে ৮১ জনের নাম যুক্ত হয়েছে। এরমধ্যে সাবেক ১৮ মন্ত্রী, সাবেক ৭ প্রতিমন্ত্রী, সাবেক ৩৮ এমপি, সাবেক দুই মেয়র, সাবেক সচিব ও উচ্চপদস্থ পুলিশ কর্মকর্তাসহ অন্যান্য সাবেক-বর্তমান কর্মকর্তারা রয়েছেন।

তাদের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার, ঘুষ, ব্যাংক ঋণ ও শেয়ার বাজার কেলেঙ্কারি, অর্থ পাচার, নিয়োগ বাণিজ্য, টেন্ডারবাজি, কমিশন বাণিজ্য, সরকারি ও বেসরকারি জমি-সম্পত্তি দখল, লুটপাটসহ নানা অনৈতিক কর্মকান্ডেরর মাধ্যমে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত বিপুল পরিমাণ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ রয়েছে।

দুদকের একাধিক কর্মকর্তা জানান, আইনে দুর্নীতি দমন কমিশন স্বাধীন হলেও অতীতে সরকারের উচ্চ মহলের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে কাজ করেছে দুদক। বিগত বছরগুলোতে আওয়ামী লীগ সরকারের বহু প্রভাবশালীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ পেলেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। কিন্তু সরকারের পতনের পরই সাবেক মন্ত্রী-এমপি ও সেই সরকারের ঘনিষ্ঠ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে গণহারে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত দিচ্ছে কমিশন। এক্ষেত্রে গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলো বিবেচনার জন্য বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।

অভিযোগসংশ্লিষ্টদের অনুসন্ধানের বিষয়ে জানতে চাইলে দুদক জানায়, তাদের (দুদক) একটি গোয়েন্দা ইউনিট রয়েছে। কারও বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়ার পর গোয়েন্দা ইউনিটের কর্মকর্তাদের দ্বারা প্রাথমিক অনুসন্ধান করা হয়। এ অনুসন্ধানে অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া গেলেই তা প্রকাশ্য অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত দেওয়া হচ্ছে।

এসব অনুসন্ধানের বিষয়ে দুদকের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন করা হলে জবাবে, দুদকের সাবেক মহাপরিচালক (অব. সিনিয়র জেলা জজ) মঈদুল ইসলাম বলেন, ‘এ সমস্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে দুর্নীতির বিষয়ে গুঞ্জন ছিল, বিভিন্ন সময় নানান মিডিয়ায় খবরও বেরিয়েছে। এমন খবর বের হওয়ার পরও দুদক থেকে তখন কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে যখন তারা ক্ষমতাচ্যুত হয়ে পলাতক হয়ে গেছে, তখন তাদের বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে।’

বর্তমান পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার জন্য দুদক নামকাওয়াস্তে এ অনুসন্ধানগুলো করছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, এ থেকে এটাই প্রমাণ হয় যে, দুদক সরকারের দিকে তাকিয়ে থেকে সরকারের চালচলন ও মেজাজ বুঝে চলার চেষ্টা করে।

মঈদুল ইসলাম বলেন, দুদকের অনুসন্ধান বছরের পর বছর ধরে চলতে থাকবে, অনেক সময় তো অনুসন্ধানের মাধ্যমে ক্লিন সার্টিফিকেটও দেওয়া হয়। ‘আমি মনে করি, যে সমস্ত খবরাখবর বেরিয়েছে তাতে করে ২-৪ দিনের মধ্যে অনুসন্ধান শেষ করে মামলা করতে পারত। অথচ দুদক এখনও সেই মামলার দিকে যায়নি। বেনজীরের খবর অনেক আগে বের হয়েছে, এখনও তাদের অনুসন্ধান শেষ হয়নি, মামলা করা হয়নি। এখন যে অনুসন্ধান শুরু হয়েছে, সেগুলো কবে মামলায় রূপান্তর হবে, এ বিষয়েও সন্দেহ আছে।’

দুদক সূত্রে জানা যায়, সোমবার (২৩ সেপ্টেম্বর) পর্যন্ত দুদকের অনুসন্ধান তালিকায় যুক্ত হয়েছেন ৮১ জন। ইতোমধ্যে তাদের সম্পদের তথ্য চেয়ে বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান, বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ), নিবন্ধন অধিদপ্তর, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি), বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ, যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মসমূহের পরিদপ্তরসহ বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে চিঠি পাঠিয়েছে দুদক।

দুদকের দায়িত্বশীল কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, যাদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু হয়েছে তাদের নির্ভরশীল ব্যক্তি ও নিকটাত্মীয়দের নামে সম্পদ আছে কিনা, তাও খতিয়ে দেখা হবে। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকজনের সম্পদসংক্রান্ত নথিপত্র হাতে এসে পৌঁছেছে, সেগুলো যাচাই-বাছাই করে দেখা হচ্ছে।

অনুসন্ধানের তালিকায় থাকা মন্ত্রীদের মধ্যে গত ১৫ আগস্ট সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের বিরুদ্ধে প্রথম অনুসন্ধান শুরুর তথ্য জানায় দুদক। এরপর এ তালিকায় যুক্ত হন সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল, সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী (জাভেদ), সাবেক নৌ পরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান, সাবেক প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান ফিজার, সাবেক পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী, সাবেক পরিবেশমন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন, প্রাণিসম্পদমন্ত্রী আব্দুর রহমান, সাবেক রেলমন্ত্রী মো. জিল্লুল হাকিম, সাবেক গণপূর্তমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম, সাবেক সমাজকল্যাণমন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদ ও শেখ হাসিনার সাবেক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান।

প্রতিমন্ত্রীরা হলেন- সাবেক বিদ্যুৎ ও জ্বলানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু, সাবেক তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক, সাবেক গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী শরীফ আহমেদ, সাবেক শ্রম প্রতিমন্ত্রী মন্নুজান সুফিয়ান, সাবেক বেসামরিক বিমান প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলী, সাবেক প্রাথমিক, গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেন ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় এবং ঢাকা-১৯ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ডা. মো. এনামুর রহমান।

সংসদ সদস্যরা হলেন- নুরুন্নবী চৌধুরী শাওন, ধীরেন্দ্র নাথ শম্ভু, নিজাম উদ্দিন হাজারী, লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী, বেনজীর আহমেদ, ড. জান্নাত আরা তালুকদার হেনরী, অসীম কুমার উকিল, অপু উকিল, শাহে আলম তালুকদার, ডা. মনসুর আহমেদ, আবুল কালাম আজাদ, সোলায়মান হক জোয়াদ্দার (ছেলুন), ইকবালুর রহিম, মো. সাইফুজ্জামান শেখর, তানভীর ইমাম, এনামুল হক, মো. আখতারুজ্জামান বাবু, শফিকুল ইসলাম শিমুল, নাঈমুর রহমান দুর্জয়, মোহাম্মদ হাবিব হাসান, মো. নুরুল ইসলাম তালুকদার, আব্দুল ওদুদ, আয়শা ফেরদৌস, রণজিত কুমার রায়, সাদেক খান, গোলাম ফারুক খন্দকার প্রিন্স, মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী, নাছিমুল আলম চৌধুরী, মাহফুজুর রহমান মিতা ও সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের ছেলে তমাল মুনসুর, এইচ এম ইব্রাহিম ও মো. শাহীন চাকলাদার ।

মেয়র, সাবেক সচিব, উচ্চপদস্থ পুলিশ কর্মকর্তাসহ অন্যান্য সাবেক-বর্তমান কর্মকর্তারা হলেন- নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী, যশোর পৌরসভার সাবেক মেয়র জহুরুল ইসলাম চাকলাদার, সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব কবির বিন আনোয়ার, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব শাহ কামাল, সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল (অব.) আজিজ আহমেদ, ঢাকা মহানগর পুলিশের সাবেক কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া ও অতিরিক্ত কমিশনার প্রধান হারুন অর রশীদ, এনএসআইয়ের সাবেক ডিজি মেজর জেনারেল (অব.) টিএম জোবায়ের, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাবেক এপিএস-২ গাজী হাফিজুর রহমান লিকু, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের দ্বিতীয় সচিব আরজিনা খাতুন, বিএসএমএমইউর সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ, জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক সৌমিত্র শেখর এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডিজিটাল ইউনিভার্সিটির সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক মুনাজ আহমেদ নূর, পুলিশের ডিআইজি মো. আব্দুল বাতেন ও সাবেক চেয়ারম্যান (বিসিআইসি) মো. হাইয়ূল কাইয়ূম।

অবৈধভাবে দেশে-বিদেশে বিপুল পরিমাণ সম্পদ গড়েছেন, এমন অভিযোগের ভিত্তিতে সাবেক মন্ত্রীদের মধ্যে যাদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। তারা হলেন- জাহিদ মালেক, দীপু মনি, মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল, সাধন চন্দ্র মজুমদার, নুরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুন, শাজাহান খান, কামরুল ইসলাম, শ ম রেজাউল করিম, কামাল আহমেদ মজুমদার, জান্নাত আরা হেনরী। 

সাবেক সংসদ সদস্যদের মধ্যে যাদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে তারা হলেন- ছলিম উদ্দিন তরফদার সেলিম, মামুনুর রশিদ কিরণ, কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা, কাজিম উদ্দিন, নুর-ই-আলম চৌধুরী ও জিয়াউর রহমান এবং ঢাকা ওয়াসার সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তাকসিম এ খান এবং পুলিশ কর্মকর্তা হারুন অর রশীদ।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সচিব খোরশেদা ইয়াসমীন বলেন,  দুদক বিভিন্ন সোর্সের মাধ্যমে খবর পায় এবং তা গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয়। তখন কিন্তু (আওয়ামী লীগ সরকারের সময়) এ ধরনের ইসপ্যসিফিক অভিযোগ আসে নাই। তাছাড়া আমাদের কিন্তু একটা গোয়েন্দা সেল আছে। ওখানে কোন কিছুই নথিজাত করা হয়নি। নথিজাত মানে হচ্ছে একেবারে ক্লোজ হয়ে যাওয়া তা কিন্তিু নয়। আমদের যে গোয়েন্দা ইউনিট রয়েছে ওখানে প্রাথমিক সত্যতা আছে কিনা তা যাচাই বাছাই চলে। কাযক্রম কিন্তু চলমান। যাচাই বাছাই করে যখন প্রথমিক সত্যতা কিছু পাওয়া যায় তার ভিত্তিতে পর পর যে অভিযোগগুলো আসছে তা প্রক্যাশে অনুসন্ধানের জন্য সিদ্ধন্ত নেওয়া হয়। গত কয়েক সপ্তাহে যতগুলো কেস আসছে এর আগে তা আসে নাসে নাই। যদি না আসে তাহলে দুদক কোথা থেকে করবে। দুদকে যে কেসগুলো আসছে বা যখনই আসে তা গুরুত্ব সহকারে দেখা হয়। বেনামে  চিঠিটাও দুদক গুরুত্ব সহকারে দেখে। ১০৬ এর মাধ্যমে যে অভিযোগগুলো আসে সেটাও গুরুত্ব সহকারে দেখা হয়। তার মানে কোন এলিগেশন যেভাবেই আসুক প্রত্যেকটা গুরুত্ব দেওয়া হয়। দেখা হয়, যে ঠিকআছে আমি তো প্রায়ই মিটিংএ থাকি অথচ একটা অভিযোগ আসছে পার্শিয়ালি এটা তো হতেও পারে। ঠিকআছে আপা তাহলে একটু চেক করি, এটা তো গোপনীয়তা। গোয়েন্দার কাজটা ঠিক প্রক্যাশে বুঝতে পারা যায় না, আসলে যে তদন্ত চলছে।

ট্যাগস
জনপ্রিয় সংবাদ

দুদকের অনুসন্ধানের তালিকায় হাসিনা সরকারের উচ্চপদস্থ ৮১ ব্যক্তি

আপডেট সময় ০৭:০৯ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪

সোহেলী চৌধুরী

ক্ষমতায় থাকাকালে আওয়ামী লীগ সরকারের বহু মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যসহ ঘনিষ্ঠ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ থাকলেও তা অনুসন্ধানের কোনো উদ্যোগ নেয়নি দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে সরকার পরিবর্তনের পরই আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী-এমপি এবং সাবেক ও বর্তমান উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের অনিয়ম-দুর্নীতি ও জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের পৃথক অনুসন্ধান শুরু করেছে দুদক।

এদিকে গত ১৫ আগস্ট থেকে শুরু হওয়া দুদকের অনুসন্ধানের তালিকায় এরইমধ্যে ৮১ জনের নাম যুক্ত হয়েছে। এরমধ্যে সাবেক ১৮ মন্ত্রী, সাবেক ৭ প্রতিমন্ত্রী, সাবেক ৩৮ এমপি, সাবেক দুই মেয়র, সাবেক সচিব ও উচ্চপদস্থ পুলিশ কর্মকর্তাসহ অন্যান্য সাবেক-বর্তমান কর্মকর্তারা রয়েছেন।

তাদের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার, ঘুষ, ব্যাংক ঋণ ও শেয়ার বাজার কেলেঙ্কারি, অর্থ পাচার, নিয়োগ বাণিজ্য, টেন্ডারবাজি, কমিশন বাণিজ্য, সরকারি ও বেসরকারি জমি-সম্পত্তি দখল, লুটপাটসহ নানা অনৈতিক কর্মকান্ডেরর মাধ্যমে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত বিপুল পরিমাণ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ রয়েছে।

দুদকের একাধিক কর্মকর্তা জানান, আইনে দুর্নীতি দমন কমিশন স্বাধীন হলেও অতীতে সরকারের উচ্চ মহলের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে কাজ করেছে দুদক। বিগত বছরগুলোতে আওয়ামী লীগ সরকারের বহু প্রভাবশালীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ পেলেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। কিন্তু সরকারের পতনের পরই সাবেক মন্ত্রী-এমপি ও সেই সরকারের ঘনিষ্ঠ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে গণহারে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত দিচ্ছে কমিশন। এক্ষেত্রে গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলো বিবেচনার জন্য বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।

অভিযোগসংশ্লিষ্টদের অনুসন্ধানের বিষয়ে জানতে চাইলে দুদক জানায়, তাদের (দুদক) একটি গোয়েন্দা ইউনিট রয়েছে। কারও বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়ার পর গোয়েন্দা ইউনিটের কর্মকর্তাদের দ্বারা প্রাথমিক অনুসন্ধান করা হয়। এ অনুসন্ধানে অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া গেলেই তা প্রকাশ্য অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত দেওয়া হচ্ছে।

এসব অনুসন্ধানের বিষয়ে দুদকের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন করা হলে জবাবে, দুদকের সাবেক মহাপরিচালক (অব. সিনিয়র জেলা জজ) মঈদুল ইসলাম বলেন, ‘এ সমস্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে দুর্নীতির বিষয়ে গুঞ্জন ছিল, বিভিন্ন সময় নানান মিডিয়ায় খবরও বেরিয়েছে। এমন খবর বের হওয়ার পরও দুদক থেকে তখন কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে যখন তারা ক্ষমতাচ্যুত হয়ে পলাতক হয়ে গেছে, তখন তাদের বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে।’

বর্তমান পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার জন্য দুদক নামকাওয়াস্তে এ অনুসন্ধানগুলো করছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, এ থেকে এটাই প্রমাণ হয় যে, দুদক সরকারের দিকে তাকিয়ে থেকে সরকারের চালচলন ও মেজাজ বুঝে চলার চেষ্টা করে।

মঈদুল ইসলাম বলেন, দুদকের অনুসন্ধান বছরের পর বছর ধরে চলতে থাকবে, অনেক সময় তো অনুসন্ধানের মাধ্যমে ক্লিন সার্টিফিকেটও দেওয়া হয়। ‘আমি মনে করি, যে সমস্ত খবরাখবর বেরিয়েছে তাতে করে ২-৪ দিনের মধ্যে অনুসন্ধান শেষ করে মামলা করতে পারত। অথচ দুদক এখনও সেই মামলার দিকে যায়নি। বেনজীরের খবর অনেক আগে বের হয়েছে, এখনও তাদের অনুসন্ধান শেষ হয়নি, মামলা করা হয়নি। এখন যে অনুসন্ধান শুরু হয়েছে, সেগুলো কবে মামলায় রূপান্তর হবে, এ বিষয়েও সন্দেহ আছে।’

দুদক সূত্রে জানা যায়, সোমবার (২৩ সেপ্টেম্বর) পর্যন্ত দুদকের অনুসন্ধান তালিকায় যুক্ত হয়েছেন ৮১ জন। ইতোমধ্যে তাদের সম্পদের তথ্য চেয়ে বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান, বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ), নিবন্ধন অধিদপ্তর, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি), বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ, যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মসমূহের পরিদপ্তরসহ বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে চিঠি পাঠিয়েছে দুদক।

দুদকের দায়িত্বশীল কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, যাদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু হয়েছে তাদের নির্ভরশীল ব্যক্তি ও নিকটাত্মীয়দের নামে সম্পদ আছে কিনা, তাও খতিয়ে দেখা হবে। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকজনের সম্পদসংক্রান্ত নথিপত্র হাতে এসে পৌঁছেছে, সেগুলো যাচাই-বাছাই করে দেখা হচ্ছে।

অনুসন্ধানের তালিকায় থাকা মন্ত্রীদের মধ্যে গত ১৫ আগস্ট সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের বিরুদ্ধে প্রথম অনুসন্ধান শুরুর তথ্য জানায় দুদক। এরপর এ তালিকায় যুক্ত হন সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল, সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী (জাভেদ), সাবেক নৌ পরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান, সাবেক প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান ফিজার, সাবেক পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী, সাবেক পরিবেশমন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন, প্রাণিসম্পদমন্ত্রী আব্দুর রহমান, সাবেক রেলমন্ত্রী মো. জিল্লুল হাকিম, সাবেক গণপূর্তমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম, সাবেক সমাজকল্যাণমন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদ ও শেখ হাসিনার সাবেক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান।

প্রতিমন্ত্রীরা হলেন- সাবেক বিদ্যুৎ ও জ্বলানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু, সাবেক তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক, সাবেক গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী শরীফ আহমেদ, সাবেক শ্রম প্রতিমন্ত্রী মন্নুজান সুফিয়ান, সাবেক বেসামরিক বিমান প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলী, সাবেক প্রাথমিক, গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেন ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় এবং ঢাকা-১৯ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ডা. মো. এনামুর রহমান।

সংসদ সদস্যরা হলেন- নুরুন্নবী চৌধুরী শাওন, ধীরেন্দ্র নাথ শম্ভু, নিজাম উদ্দিন হাজারী, লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী, বেনজীর আহমেদ, ড. জান্নাত আরা তালুকদার হেনরী, অসীম কুমার উকিল, অপু উকিল, শাহে আলম তালুকদার, ডা. মনসুর আহমেদ, আবুল কালাম আজাদ, সোলায়মান হক জোয়াদ্দার (ছেলুন), ইকবালুর রহিম, মো. সাইফুজ্জামান শেখর, তানভীর ইমাম, এনামুল হক, মো. আখতারুজ্জামান বাবু, শফিকুল ইসলাম শিমুল, নাঈমুর রহমান দুর্জয়, মোহাম্মদ হাবিব হাসান, মো. নুরুল ইসলাম তালুকদার, আব্দুল ওদুদ, আয়শা ফেরদৌস, রণজিত কুমার রায়, সাদেক খান, গোলাম ফারুক খন্দকার প্রিন্স, মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী, নাছিমুল আলম চৌধুরী, মাহফুজুর রহমান মিতা ও সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের ছেলে তমাল মুনসুর, এইচ এম ইব্রাহিম ও মো. শাহীন চাকলাদার ।

মেয়র, সাবেক সচিব, উচ্চপদস্থ পুলিশ কর্মকর্তাসহ অন্যান্য সাবেক-বর্তমান কর্মকর্তারা হলেন- নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী, যশোর পৌরসভার সাবেক মেয়র জহুরুল ইসলাম চাকলাদার, সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব কবির বিন আনোয়ার, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব শাহ কামাল, সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল (অব.) আজিজ আহমেদ, ঢাকা মহানগর পুলিশের সাবেক কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া ও অতিরিক্ত কমিশনার প্রধান হারুন অর রশীদ, এনএসআইয়ের সাবেক ডিজি মেজর জেনারেল (অব.) টিএম জোবায়ের, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাবেক এপিএস-২ গাজী হাফিজুর রহমান লিকু, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের দ্বিতীয় সচিব আরজিনা খাতুন, বিএসএমএমইউর সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ, জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক সৌমিত্র শেখর এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডিজিটাল ইউনিভার্সিটির সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক মুনাজ আহমেদ নূর, পুলিশের ডিআইজি মো. আব্দুল বাতেন ও সাবেক চেয়ারম্যান (বিসিআইসি) মো. হাইয়ূল কাইয়ূম।

অবৈধভাবে দেশে-বিদেশে বিপুল পরিমাণ সম্পদ গড়েছেন, এমন অভিযোগের ভিত্তিতে সাবেক মন্ত্রীদের মধ্যে যাদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। তারা হলেন- জাহিদ মালেক, দীপু মনি, মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল, সাধন চন্দ্র মজুমদার, নুরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুন, শাজাহান খান, কামরুল ইসলাম, শ ম রেজাউল করিম, কামাল আহমেদ মজুমদার, জান্নাত আরা হেনরী। 

সাবেক সংসদ সদস্যদের মধ্যে যাদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে তারা হলেন- ছলিম উদ্দিন তরফদার সেলিম, মামুনুর রশিদ কিরণ, কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা, কাজিম উদ্দিন, নুর-ই-আলম চৌধুরী ও জিয়াউর রহমান এবং ঢাকা ওয়াসার সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তাকসিম এ খান এবং পুলিশ কর্মকর্তা হারুন অর রশীদ।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সচিব খোরশেদা ইয়াসমীন বলেন,  দুদক বিভিন্ন সোর্সের মাধ্যমে খবর পায় এবং তা গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয়। তখন কিন্তু (আওয়ামী লীগ সরকারের সময়) এ ধরনের ইসপ্যসিফিক অভিযোগ আসে নাই। তাছাড়া আমাদের কিন্তু একটা গোয়েন্দা সেল আছে। ওখানে কোন কিছুই নথিজাত করা হয়নি। নথিজাত মানে হচ্ছে একেবারে ক্লোজ হয়ে যাওয়া তা কিন্তিু নয়। আমদের যে গোয়েন্দা ইউনিট রয়েছে ওখানে প্রাথমিক সত্যতা আছে কিনা তা যাচাই বাছাই চলে। কাযক্রম কিন্তু চলমান। যাচাই বাছাই করে যখন প্রথমিক সত্যতা কিছু পাওয়া যায় তার ভিত্তিতে পর পর যে অভিযোগগুলো আসছে তা প্রক্যাশে অনুসন্ধানের জন্য সিদ্ধন্ত নেওয়া হয়। গত কয়েক সপ্তাহে যতগুলো কেস আসছে এর আগে তা আসে নাসে নাই। যদি না আসে তাহলে দুদক কোথা থেকে করবে। দুদকে যে কেসগুলো আসছে বা যখনই আসে তা গুরুত্ব সহকারে দেখা হয়। বেনামে  চিঠিটাও দুদক গুরুত্ব সহকারে দেখে। ১০৬ এর মাধ্যমে যে অভিযোগগুলো আসে সেটাও গুরুত্ব সহকারে দেখা হয়। তার মানে কোন এলিগেশন যেভাবেই আসুক প্রত্যেকটা গুরুত্ব দেওয়া হয়। দেখা হয়, যে ঠিকআছে আমি তো প্রায়ই মিটিংএ থাকি অথচ একটা অভিযোগ আসছে পার্শিয়ালি এটা তো হতেও পারে। ঠিকআছে আপা তাহলে একটু চেক করি, এটা তো গোপনীয়তা। গোয়েন্দার কাজটা ঠিক প্রক্যাশে বুঝতে পারা যায় না, আসলে যে তদন্ত চলছে।