সোহেলী চৌধুরী
ডিমের দাম সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখার জন্য বেশকিছু উদ্যোগ গ্রহণ করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। তার সুফলও মিলছে। তবে সবজির দাম কিছুটা কমে আসলেও সাধারণ মানুষ খুশি নন। এবার অস্বাভাবিকভাবে বাড়ছে মুরগির দাম। মাছ ও গরুর মাংসের দাম আগের মতোই আছে। সব মিলিয়ে বাজার পরিস্থিতি নিম্ন ও মধ্যবিত্তের জন্য সুখকর নয় পুরোপুরি। শুক্রবার ও শনিবার যথাক্রমে (১৮ ও ১৯ অক্টোবর) রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে।
বাজারে কয়েক সপ্তাহ ধরে বেশ আলোচনায় ডিম। বিশেষ করে চলতি সপ্তাহে প্রতি ডজন ডিমের দাম ১৮০ টাকা পর্যন্ত উঠেছিল। তবে এ দাম এখন বড়বাজারে ১৫০ টাকায় নেমেছে। যদিও পাড়া-মহল্লায় ব্যবসায়ীদের মধ্যে কেউ কেউ এখনো ডিম বিক্রি করছেন ১৬০ টাকায়। সরকার এরমধ্যে ডিমের শুল্কছাড়, আমদানির অনুমতি এবং বেঁধে দেওয়া দামে ডিম বিক্রি করতে ব্যবসায়ীদের কঠোর নির্দেশনা দিয়েছে।
ব্যবসায়ীরা জানান, বাজারে সরকারের বিভিন্ন সংস্থার নিয়মিত অভিযান এবং খামারি ও করপোরেটদের ডিম সরবরাহ বাড়ানোর কারণে দাম কমে আসছে। তা ছাড়া শুল্কছাড়ের সঙ্গে সরকার নতুন করে আরো সাড়ে চার কোটি ডিম আমদানির অনুমতি দিচ্ছে। এটিও দাম কমার পেছনে অনুঘটক হিসেবে কাজ করছে।
এদিকে একই সময় বাজারে প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগির দাম ১০ টাকা বাড়তে দেখা গেছে। এ মুরগির দাম আগের সপ্তাহেও বেড়েছিল। যা এখন বিক্রি হচ্ছে ২০৫ থেকে ২১৫ টাকা পর্যন্ত। যা দুই সপ্তাহ আগে ১৮০ টাকার মধ্যে ছিল।
অন্যদিকে, অস্বাভাবিকভাবে সোনালি মুরগির দাম কেজিপ্রতি প্রায় ৫০ টাকা বেড়ে ৩২০ থেকে ৩৩০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। যা গত সপ্তাহে ২৭০-২৮০ টাকা ছিল। মাসখানেক ধরে উত্তাপ ছড়ানো সবজির বাজার কিছুটা কমতির দিকে রয়েছে বলে জানিয়েছেন বাজার সংশ্লিষ্টরা।
বাজার ঘুরে দেখা গেছে, এখনো অধিকাংশ সবজির দাম ৮০ থেকে ১০০ টাকার মধ্যেই রয়ে গেছে, যা সাধারণ ক্রেতাদের জন্য মোটেই স্বস্তিদায়ক নয়। তবে পেঁপেসহ কিছু সবজি নেমে এসেছে ৫০-৬০ টাকার মধ্যে। বিক্রেতারা বলছেন, মাসখানেকের মধ্যে বাজারের উত্তাপ আরো কমে আসবে।
বাজারে সবচেয়ে কমদামের সবজি পেঁপে বিক্রি হচ্ছে ৪০ টাকায়। এরপর রয়েছে পটল, যার দাম কেজিপ্রতি ৬০ টাকা। এ ছাড়া ঢেঁড়স ৮০-৯০, বরবটি ১০০-১২০, গোল বেগুন ১৩০-১৪০, লম্বা বেগুন ১০০-১২০, টমেটো ১৮০-১৯০, ধুন্দল, ঝিঙে ও চিচিঙ্গা ১০০-১২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। কচুরমুখীর কেজি ৮০ থেকে ১০০ টাকা। এ ছাড়া বাজারে করলার কেজি ৮০ থেকে ১০০ টাকা, কাঁকরোল ১২০ টাকা, প্রতি পিস লাউ বিক্রি হচ্ছে ৬০ থেকে ৮০ টাকায়।
বাজারে শীতকালীন সবজি শিমের কেজি ৪৮০ টাকা, ফুলকপি প্রতি পিস ৬০ থেকে ৮০ টাকা, ছোট আকারের বাঁধাকপি ৮০ টাকা, গাজর ১৮০ টাকা ও মুলা ৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। লেবুর হালি ৩০ থেকে ৬০ টাকা। ধনে পাতার কেজি ৬০০ টাকা, কাঁচা কলার হালি ৮০ টাকা, চালকুমড়া প্রতিটি ৮০ টাকা। বাজারে মিষ্টিকুমড়ার কেজি ৬০ থেকে ৭০ টাকা।
এদিকে সপ্তাহজুড়ে তেজ ছড়ানো কাঁচামরিচের দাম কিছুটা কমতে শুরু করেছে। প্রতিকেজি বিক্রি হচ্ছে ২৪০ থেকে ৩০০ টাকা দরে। যদিও এখনো কিছু কিছু খুচরা দোকানি এখনো প্রতি এক পোয়া (২৫০ গ্রাম) কাঁচামরিচের দাম ৮০ থেকে ১০০ টাকা হাঁকছেন। তারা ১০০ গ্রাম বিক্রি করছেন ৪০ টাকায়।
খুচরা বাজারের বিক্রেতারা বলছেন, টানা বৃষ্টির কারণেই সবজির দাম হঠাৎ বেড়েছে। তবে বৃষ্টি কমলে বাজারে সবজি সরবরাহ বাড়বে তখন দাম নাগালে চলে আসবে। আবার অনেকেই বলছেন, উত্তরবঙ্গে বন্যার কারণে সবজির বাজারে বাড়তি চাপ পড়েছে। অন্যদিকে বাজারে গরুর মাংস আগের মতো বাড়তি দামে প্রতি কেজি ৭৫০ থেকে ৭৮০ টাকা, খাসির মাংস প্রতি কেজি এক হাজার ১০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
এদিকে বাজারে মাছ বিক্রি হচ্ছে আগের বাড়তি দামেই। প্রতি কেজি রুই ৩৮০ থেকে ৪৫০ টাকা, কাতল ৪০০ থেকে ৪৮০ টাকা, চাষের শিং ৫৫০ টাকা, চাষের মাগুর ৫০০ টাকা, চাষের কৈ ২২০ থেকে ২৫০ টাকা, কোরাল ৭০০ থেকে ৭৫০ টাকা, টেংরা ৫৫০ থেকে ৭০০ টাকা, চাষের পাঙাশ ১৮০ থেকে ২৩০ টাকা ও তেলাপিয়া ১৭০ থেকে ২২০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে।
প্রতি কেজি বোয়াল ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা, আইড় ৮৫০ থেকে ৯০০ টাকা, দেশি কৈ এক হাজার ৩০০ টাকা থেকে এক হাজার ৭০০ টাকা, শিং এক হাজার ৪০০ থেকে এক হাজার ৫০০ টাকা, শোল ৯০০ থেকে এক হাজার টাকা ও নদীর পাঙাশ বিক্রি হচ্ছে ৯০০ থেকে এক হাজার ২০০ টাকায়। বেড়ে গেছে আদা-রসুনের দামও। প্রতি কেজিতে ৫-১৫ টাকা পর্যন্ত বেড়ে প্রতি কেজি দেশি রসুন ২৪০ টাকা, আমদানি করা রসুন ২৬০ টাকা ও মানভেদে আদা বিক্রি হচ্ছে ২২০-২৮০ টাকায়।
সুখবর নেই আলু-পেঁয়াজের বাজারেও। কেজিতে পাঁচ টাকা বেড়ে প্রতিকেজি আলু বিক্রি হচ্ছে ৬০ টাকায়। আর পেঁয়াজ নতুন করে না বাড়লেও বিক্রি হচ্ছে আগের বাড়তি দামেই। খুচরায় প্রতিকেজি দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ১২০-১৩০ টাকায়। ভারতীয় পেঁয়াজ যথাক্রমে ১০০-১১০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আর পাইকারি পর্যায়ে প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ ১১২-১১৫ টাকা ও ভারতীয় পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৯২-৯৬ টাকায়।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, দেশি পেঁয়াজের মৌসুম শেষের দিকে। তাই বাজার চড়েছে। অগ্রহায়ণের মাঝামাঝি সময়ে নতুন পেঁয়াজ বাজারে আসতে শুরু করবে; তখন দাম কমে আসবে।
এদিকে চলতি সপ্তাহে তেল ও চিনিতেও শুল্কছাড় দিয়েছে নতুন সরকার। কয়েকজন খুচরা ব্যবসায়ী জানান, শুল্ক কমানোর খবরে পাইকাররা তেল ও চিনির দরে কিছুটা ছাড় দিচ্ছে। তবে ভোক্তারা শুল্কছাড়ের সুফল পেতে কিছু দিন সময় লাগবে। চিনির দর নতুন করে বাড়েনি। বরং এক সপ্তাহে পাইকারিতে বস্তায় (৫০ কেজি) ১০০-২০০ টাকার মতো কমেছে। দুই-তিন দিনের মধ্যে এসব পণ্যের খুচরা দাম কমে আসবে বলে আশা করা যাচ্ছে।
রামপুরা বাজারে মুরগির বিক্রেতা ফারুক হোসেন বলেন, হুট করেই সরবরাহ কমিয়ে মুরগির দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন পাইকাররা। তারা (পাইকারি বিক্রেতারা) জানিয়েছেন বন্যা ও বৃষ্টির কারণে মুরগির সরবরাহ কম।
বাড্ডায় বাজার করতে আসা শরিফুল ইসলাম নামে এক ক্রেতা বলেন, দুই-তিনটা সবজি কিনলেই ৫০০ টাকা শেষ হয়ে যাচ্ছে। তাহলে অন্যান্য বাজার কীভাবে করব। এ বিষয়গুলো সরকারের পক্ষ থেকে সরাসরি তদারকি করা প্রয়োজন। নতুন সরকারের কাছে মানুষের অনেক প্রত্যাশা। কিন্তু সে অনুযায়ী কিছুই আমরা দেখছি না।
খিলগাঁও বাজারে এনামুল হাসান নামে আরেক ক্রেতা বলেন, ২৫০ গ্রাম কাঁচামরিচ কিনতেই ৮০ টাকা লাগছে। আর অন্যান্য সবজি কেনার মতো উপায় নেই। সব সবজিই মোটামুটি ১০০ টাকার আশপাশে দাম। বাজারে এই পরিস্থিতি চলতে থাকলে সাধারণ মানুষের কষ্ট বেড়ে যাবে।
রামপুরা সাদ্দাম হোসেন নামে এক বিক্রেতা বলেন, বাজারে কাঁচামরিচসহ কিছু সবজির দাম কমতে শুরু করেছে। উত্তরবঙ্গে বৃষ্টি ও বন্যার কারণে এমন পরিস্থিতি হয়েছে। অধিকাংশ সবজিতো ওইদিক থেকেই আসে। প্রায় সব সবজির দামই চড়া। তাই কাস্টমার বেশি সবজি নেয় না। দাম কম থাকলে আমাদের বিক্রিও ভালো হয়। তবে আশা করছি মাসখানেকের মধ্যেই শীতের সবজিতে বাজার ভরপুর হয়ে যাবে, সেই সঙ্গে দামও ঠিক হয়ে যাবে।
মালিবাগ বাজারে বেসরকারি চাকরিজীবী খোরশেদ আলম বলেন, দেশি মুরগি, গরু, খাসির মাংস তো অতিরিক্ত দামের কারণে খেতে পারি না। খাওয়ার মধ্যে কোনোভাবে কিনি ব্রয়লার আবার কোনো কোনো সময় সোনালি মুরগি। কিন্তু বর্তমান বাজারের যে অবস্থা তাতে করে ব্রয়লার মুরগিও কেনা এখন দায় হয়ে গেছে। ২১০ টাকা কেজি ব্রয়লার। আর সোনালি মুরগি ৩২০ টাকা। সরকার গতমাসে ব্রয়লার মুরগির দাম নির্ধারণ করে দিল, কিন্তু এরপর থেকে একটি দিনের জন্যও ব্রয়লার নির্ধারিত দামে বিক্রি হয়নি। সংশ্লিষ্টদের যদি বাজারে মনিটরিং না থাকে তাহলে শুধু দাম নির্ধারণের ঘোষণা দিয়ে কী লাভ?
মহাখালী বাজারে গার্মেন্টস কর্মী মনছুর আলী বলেন, ব্রয়লার মুরগির দাম নির্ধারণের পর থেকে বেড়েছে। স্বল্প ইনকামের লোক আমরা যে কারণে এমনিতে বাজারে আসলে দিশেহারা হয়ে যাই। মাংস কেনা বলতে আমরা স্বল্প আয়ের মানুষরা শুধু বুঝি ব্রয়লার মুরগি, কারণ অন্যগুলো কেনার সামর্থ্য আমাদের নেই। সেই ব্রয়লারের দামও এখন বেশি চলছে। তাহলে আমরা কোনটা কিনব?
মগবাজার এলাকার মাংস বিক্রেতা হাবিবুর রহমান বলেন, আসলে আমাদের কেনা দাম বেশি পড়ছে তাই খুচরা বাজারে এমন দাম চলছে। আমরা যদি তুলনামূলক কম দামে গরু-খাসি কিনতে পারি তাহলে ক্রেতা পর্যায়ে কম দাম রাখতে পারব।
উত্তর বাড্ডা এলাকার মুরগি বিক্রেতা আলমগীর হোসেন বলেন, বাজারে ব্রয়লার মুরগির দাম একটু বেশি যাচ্ছে, পাশাপাশি অন্য সব ধরনের মুরগির দামই কিছুটা বাড়তি যাচ্ছে। মূলত পাইকারি বাজারে আমাদের কেনা দাম বেশি পড়ছে যার প্রভাব পড়েছে খুচরা বাজারে। আসলে কিছুদিন আগে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বন্যার কারণে প্রচুর পরিমাণে মুরগির খামার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সেই কারণে বাজারে চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম, এর ফলে দাম বেড়েছে।