সোহেলী চৌধুরী
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) প্রধান কাজ হচ্ছে দেশের দুর্নীতি দমন, নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ। স্বাধীন ও নিরপেক্ষ থেকে এই কাজগুলো করার জন্যই গঠিত এই সংস্থাটি। তবে ক্ষমতাসীনদের দুর্নীতি অনুসন্ধান নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে দুদকেরে বিরুদ্ধে। প্রায় প্রতিদিনই সদ্য ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের সাবেক মন্ত্রী-এমপি ও তাদের পরিবারের দুর্নীতি অনুসন্ধানে তদন্ত শুরু করেছে দুদক। গতি হারিয়েছে আড়াই-তিন মাস আগেও তুমুল আলোচনায় থাকা অনুসন্ধানগুলো।
এদিকে সদ্য ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী সরকারের সংসদ সদস্য ও প্রভাবশালী দেড় শতাধিক ব্যক্তির বিরুদ্ধে অনুসন্ধান, অনুসন্ধান কমিটি গঠন ও দপ্তরে চিঠি পাঠিয়েছে দুদক। একের পর এক নতুন অনুসন্ধানের ফাইল জমা পড়ছে কর্মকর্তাদের টেবিলে। এতে করে গত (৫ আগস্টে’র) পূর্ববর্তী সময়ের অনুসন্ধানের ফাইলগুলোর কাজে নেমে এসেছে ধীর গতি।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) রোগীর পরীক্ষা-নিরীক্ষা বাবদ নেওয়া অর্থ তহবিলে জমা না দেওয়া, বিল-ভাউচার ছাড়া ব্যয়সহ বিভিন্ন খাতে অনিয়ম ও ২৪৬ কোটি টাকা লুটপাটের অভিযোগে গত বছর অনুসন্ধানে নামে দুদক। এক বছরের বেশি সময় পার হলেও তা শেষ হয়নি। বিএসএমএমইউর একাধিক কর্মকর্তাকে তলবও করে দুদক। ক্ষমতার পট পরিবর্তনে নতুন নতুন অনুসন্ধান-তলব শুরু হওয়ায় ওই অনুসন্ধানটি চলে গেছে অন্তরালে।
সরকার পতনের আগে আলোচনায় থাকা সাবেক এনবিআর সদস্য মতিউর, এনবিআর কর্মকর্তা কাজী আবু মাহমুদ ফয়সাল ও এনামুলের অনুসন্ধান স্থবির হয়ে আছে। পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে পাসপোর্ট জালিয়াতির মামলা হলেও মামলা হয়নি অবৈধ সম্পদের। স্পেশাল ব্রাঞ্চে (এসবি) কর্মরত অতিরিক্ত ডিআইজি শেখ রফিকুল ইসলাম শিমুল ও পুলিশের একাধিক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে শুরু হওয়া তদন্তেও গতি নেই।
কয়েক দফায় সময়ক্ষেপণ করে সেপ্টেম্বর মাসে দুদকে সম্পদের বিবরণী জমা দিয়েছেন সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ ও ছাগলকাণ্ডে আলোচিত সাবেক রাজস্ব কর্মকর্তা মতিউর রহমান। গত এপ্রিলে একটি জাতীয় দৈনিকে বেনজীরের অবৈধ সম্পদের ফিরিস্তি প্রকাশ করা হয়। এরপর ২২ এপ্রিল বেনজীরের সম্পদ অনুসন্ধানে নামে দুদক।
বেনজীর, তার স্ত্রী ও কন্যাকে দুই দফা সময় দিয়ে তলব করলেও কেউই আসেননি দুদকে। জব্দ করা হয়েছে বেনজীরের শত কোটি টাকার সম্পদ ও ব্যাংক অ্যাকাউন্ট। গত ১৪ অক্টোবর পাসপোর্ট জালিয়াতির অভিযোগে বেনজীরসহ পাঁচজনের নামে মামলা করে দুদক। তবে বেনজীরের বিরুদ্ধে এখনো অবৈধ সম্পদের মামলা হয়নি।
একই অবস্থা ছাগলকাণ্ডে আলোচিত মতিউরের। গত ২৩ জুন মতিউরের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। পাঁচ মাসেও অনুসন্ধান শেষ করতে পারেনি সংস্থাটি। এর মধ্যে বদল করা হয়েছে একজন তদন্ত কর্মকর্তাও।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তদন্ত সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, মতিউরের সম্পদ অনুসন্ধান করা বিশাল কাজ। পাঁচ-ছয়টি জেলায় তার সম্পদ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। তার স্ত্রীরও সম্পদ প্রচুর। ভূমি অফিসসহ একাধিক অফিসে চিঠি দেওয়া হয়েছে। কিছু জায়গার চিঠি এসেছে। জুন-জুলাইয়ে আন্দোলনের কারণে কিছু আসতে দেরি হয়েছে। অনুসন্ধান প্রভাবিত করতে মতিউর বিভিন্নভাবে চাপ প্রয়োগ করছেন।
দুদক আইন-২০০৪ অনুযায়ী ১২০ কার্যদিবসের মধ্যেই তদন্তকারী কর্মকর্তাকে তদন্ত শেষ করতে হয়। তদন্তকারী কর্মকর্তা ওই সময়ের মধ্যে তদন্ত শেষ করতে না পারলে তিনি সময় বাড়ানোর আবেদন করতে পারেন। সেক্ষেত্রে তিনি আরও ৬০ কার্যদিবস সময় পেতে পারেন। তবে মতিউর-বেনজীর কাণ্ডে তদন্তকারী কর্মকর্তা কোনো সময় বাড়ানোর আবেদন করেননি বলে জানা যায়।
দুদকের ভিন্ন একটি সূত্রের দাবি- নতুন অনুসন্ধানে আগ্রহ, অভ্যন্তরীণ চাপ ও সম্পদের কূল-কিনারা করতে না পারায় বেনজীর ও মতিউরের বিরুদ্ধে মামলা করতে পারছে না দুদক। একই কারণে এনবিআর কর্মকর্তা ফয়সাল, ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) সাবেক কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া, ডিআইজি শেখ রফিকুল ইসলাম শিমুলের অনুসন্ধানও খুব বেশি এগোচ্ছে না। গত জুনে ফয়সাল, আগস্টে আছাদুজ্জামায় মিয়া ও সেপ্টেম্বরে শিমুলের অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধানে নামে দুদক।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে দুদকের মহাপরিচালক (প্রতিরোধ) আক্তার হোসেন বলেন, ‘অনুসন্ধান কর্মকর্তা তার এখতিয়ার অনুযায়ী কাজ করছেন। আইন ও বিধি অনুযায়ী প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান চলছে। এখানে কোনো বাধা নেই। অনুসন্ধান শেষ হলে জড়িতদের বিরুদ্ধে মামলা হবে।’
এ সময় বেনজীরের অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধান স্থবির হয়ে আছে কেন জানতে চাইলে- জবাবে তিনি বলেন, ‘তথ্যটি সঠিক নয়। বেনজীরের বিরুদ্ধে পাসপোর্ট জালিয়াতির মামলা হয়েছে। সম্পদের অনুসন্ধান বিধি মোতাবেক চলছে।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে দুদকের দু’জন উপ-পরিচালক জানান, আওয়ামী লীগ সরকারের এমপি-মন্ত্রীদের সম্পদ অনুসন্ধানে ব্যস্ত কমিশন। নতুন নতুন ফাইল আসায় পুরোনো ফাইলের গুরুত্ব হারিয়েছে। তবে দুদক সূত্রে জানা যায়, আইন অনুবিভাগের অনাপত্তি সত্ত্বেও অনুসন্ধানের কার্যক্রমে কোনো অগ্রগতি নেই।
নতুন অনুসন্ধান প্রসঙ্গে দুর্নীতি দমন সংস্কার কমিশনের প্রধান ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘যারা ক্ষমতায় থাকেন তাদের বিরুদ্ধে দুদক কখনোই পদক্ষেপ নেয়নি। তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধানে কোনো কার্যকর ভূমিকা পালন করেনি। সক্ষমতা ও দক্ষতার ঘাটতির কারণে অনুসন্ধানে দীর্ঘসূত্রতা হচ্ছে বলে মনে করেন তিনি। এ সময় দুদক সংস্কার ও ঢেলে সাজানোর বিকল্প নেই বলেও জানান।
প্রসঙ্গত, ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত এক বছরের অনুসন্ধান তদন্তের উপর ভিত্তি করে বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে সংস্থাটি। বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্য মতে, গত এক বছর দুদকে ১৯ হাজার ৩৩৮টি অভিযোগ জমা পরে। যাচাই বাছাই শেষে ৯০১ অভিযোগ অনুসন্ধানের জন্য গ্রহণ করেছে সংস্থাটি, যা মোট অভিযোগের ৪ দশমিক ৬৫ শতাংশ।
২০১৭ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত গত ছয় বছরে দুদকে জমা পড়া অভিযোগ ও অনুসন্ধানের পরিসংখ্যান বলছে, এই অর্ধযুগে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অভিযোগ জমা পড়েছে ২০২২ সালে। ২০২১ সালে সংস্থাটিতে অভিযোগ জমা পড়ে ১৪ হাজার ৭৮৯টি, অভিযোগ থেকে অনুসন্ধানের জন্য গ্রহণ করা হয় ৫৩৩টি, যা মোট প্রাপ্ত অভিযোগের ৩ দশমিক ৬০ শতাংশ। ২০২০ সালে ১৮ হাজার ৪৮৯টি অভিযোগ জমা পড়ে। অনুসন্ধানের জন্য গ্রহণ করে ৮২২টি, যা মোট অভিযোগের ৪ দশমিক ৩২ শতাংশ। গত ছয় বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম এটিই।
একইভাবে ২০১৯ সালে ২১ হাজার ৩৭১টি অভিযোগ জমা পড়ে। যা গত ছয় বছরের সর্বোচ্চ। এই সময়ে সর্বোচ্চ সংখ্যাক অভিযোগ অনুসন্ধানের জন্য গ্রহণ করা হয়েছে, এক হাজার ৭১০টি। যা মোট অভিযোগের ৮ শতাংশ। ২০১৮ সালে অভিযোগ জমা পড়ে ১৬ হাজার ৬০৬টি, অনসন্ধানের জন্য নেওয়া হয় এক হাজার ২৬৫টি (৭ দশমিক ৬১ শতাংশ) এবং ২০১৭ সালে অভিযোগ পড়ে ১৭ হাজার ৯৮৩টি অুনসন্ধানের জন্য গ্রহণ করা হয় ৯৩৭টি (৫ দশমিক ২১ শতাংশ)।
২০২২ সালে দুদকের প্রধান কার্যালয়ে সরাসরি অভিযোগ জমা পড়েছে ১১ হাজার ৭৯৬টি যা মোট অভিযোগের ৬০ শতাংশ। সরকারি দফতর বা সংস্থা থেকে অভিযোগ এসেছে ৯৬৭টি, যা প্রাপ্ত অভিযোগের ৫ শাতংশ, বেসরকারি দফতর সংস্থা থেকে ৩৮৭টি (২ শাতংশ), পত্র-পত্রিকা বা টেলিভিশনের প্রতিবেদন থেকে এক হাজার ৩৫৪টি (৭ শতাংশ), বিভাগীয় কার্যালয় থেকে এক হাজার ৫৪৭টি (৮ শতাংশ), এনফোর্সমেন্ট থেকে ৫৮০টি (৩ শতাংশ) ও অন্যন্য মাধ্যমে ২ হাজার ৭০৭টি (১৪ শতাংশ)।
২০২২ সালে দুদক বিভিন্ন মামলায় আসামিদেরকে ২ হাজার ৬৩২ কোটি ৪১ লাখ ৪৩ হাজার ৭৮৩ টাকা জরিমানা করে। এই সময়ে রাষ্ট্রের অনুকূলে আদালতের নির্দেশে ১৩ কোটি ৯৬ লাখ ১৯ হাজার ১৬৭ টাকা বাজেয়াপ্ত করে সংস্থাটি। এছাড়া গত এক বছরে ৫৮৫ কোটি ৯২ লাখ ৫৮ হাজার ১৫৬ টাকার স্থাবর সম্পত্তি ক্রোক কর কমিশন।