সিনিয়র রিপোর্টার
ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে ২০ জন সাবেক মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা, প্রতিমন্ত্রী, সংসদ সদস্য, সাবেক বিচারপতি, পুলিশ ও সেনা কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার দেখিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।
একই সঙ্গে ঢাকা মহানগর পুলিশের সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমানসহ ১৭ জন পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নতুন করে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন এই আদালত।
রবিবার (২৭ অক্টোবর) দুপুরে উচ্চ আদালত প্রাঙ্গণে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এই আদেশ দেওয়া হয়েছে বলে জানান আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। পৃথক তিনটি আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এই আদেশ দেন আদালত।
গ্রেপ্তার করা আসামিদের ১৪ জনকে ১৮ নভেম্বর, ছয় জনকে ২০ নভেম্বর এবং গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা আসামিদের ২০ নভেম্বর আদালতে হাজির করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি গোলাম মর্তুজা মজুমদার, ট্রাইব্যুনালের দুই সদস্য বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ এবং অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ মহিতুল হক এনাম চৌধুরী উপস্থিত ছিলেন।
পরে আদালত প্রাঙ্গণে সাংবাদিকদের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেন, আজকের এই ট্রাইব্যুনালে তিনটি আবেদনপত্র উপস্থাপন করেছি। তার একটি ছিল আগে যাদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছিল এবং এর বাইরেও যারা এই মামলার অভিযুক্ত, এ রকম বেশ কয়েকজন ব্যক্তি গ্রেপ্তার হয়েছেন। তাদের শোন অ্যারেস্ট দেখানোর জন্য দুটি আবেদন করেছি আলাদাভাবে। সেই আবেদনে মোট ২০ জনের বিরুদ্ধে তাদের এ মামলায় গ্রেপ্তারি দেখানোর আবেদন মঞ্জুর করেছেন এবং তাদের এই মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। একটি আবেদনে ১৪ জন গ্রেপ্তার হয়েছেন।
তারা হলেন- সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সাবেক মন্ত্রী ফারুক খান, সাবেক সমাজকল্যাণমন্ত্রী দীপু মনি, ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) সভাপতি হাসানুল হক ইনু, সাবেক তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্মেদ পলক, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জ্বালানি, খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎবিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, সাবেক কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক, সাবেক সংসদ সদস্য শাজাহান খান, সাবেক শিল্প প্রতিমন্ত্রী কামাল আহমেদ মজুমদার, সাবেক বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী, অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব মো. জাহাঙ্গীর আলম। এই ১৪ জনকে আগামী ১৮ নভেম্বর এই আদালতে উপস্থিত করার জন্য নির্দেশ প্রদান করেছেন বলে জানান চিফ প্রসিকিউটর।
দ্বিতীয় আবেদনে ছয়জনকে গ্রেপ্তার দেখানোর জন্য আবেদন করা হয়েছিল। তারা হলেন- পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন, বরখাস্ত মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান, বরখাস্ত ঢাকা জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আবদুল্লাহিল কাফী, পুলিশ কর্মকর্তা আরাফাত হোসেন, আবুল হাসান ও মাজহারুল ইসলাম। তারা বিভিন্ন মামলার গ্রেপ্তার হয়ে হাজতে আছেন। তাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়ায় গ্রেপ্তারি আবেদন করা হয়েছিল এবং আদালত তা মঞ্জুর করেছেন। তাদের ২০ নভেম্বর এই আদালতে হাজির করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে জানান চিফ প্রসিকিউটর।
তৃতীয় আরেকটি আবেদনে ১৭ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির জন্য আবেদন করা হয়েছিল। আদালত পর্যালোচনা করে সেই গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন।
মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেন, এই ১৭ জনের সবাই পুলিশ কর্মকর্তা। তারা যেন পালিয়ে যেতে না পারেন, সে কারণে সবার নাম বলা সম্ভব হচ্ছে না। যার ১ নম্বরে আছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান।
অবশ্য নানা সূত্রে জানা যায়, সাবেক আইজিপি আবদুল্লাহ আল মামুন, র্যাবের সাবেক মহাপরিচালক ব্যারিস্টার হারুন অর রশিদ, সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক মনিরুল ইসলাম, ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) সাবেক অতিরিক্ত কমিশনার হারুন অর রশিদ, ঢাকা মহানগর পুলিশের সাবেক অতিরিক্ত কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার, সাবেক অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক প্রলয় কুমার জোয়ার্দার এই তালিকায় আছেন।
উল্লেখ্য, জুলাই-আগস্টে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে দুই মামলায় গত ১৭ অক্টোবর সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার পরিবারের সদস্যসহ ৪৬ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।
তাদের মধ্যে শেখ হাসিনার বোন শেখ রেহানা, শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়, শেখ হাসিনার ফুপাতো ভাই সাবেক এমপি শেখ ফজলুল করিম সেলিম, তার দুই ভাতিজা ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র ফজলে নূর তাপস, যুবলীগ চেয়ারম্যান শেখ ফজলে শামস পরশের নামও রয়েছে।
গত ৫ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত সময়ে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মধ্যে সারা দেশে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অর্ধশতাধিক অভিযোগ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা ও প্রসিকিউশন অফিসে জমা পড়েছে।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাড়াও তার সরকারের মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী, সাহিত্যিক ও গণমাধ্যমকর্মীদের অনেককে সেসব মামলার আসামি করা হয়েছে।