সোহেলী চৌধুরী
আজারবাইজানের রাজধানী বাকুতে জাতিসংঘের ২৯তম জলবায়ু সম্মেলন (কপ-২৯) বসেছিল গত ১১ থেকে ২৩ নভেম্বর। অথচ এ সম্মেলন হওয়ার কথা ছিল ২২ নভেম্বর পর্যন্ত। জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতি পোষাতে উন্নত দেশগুলোর কাছে অর্থায়নের প্রস্তাব ছিল বছরে এক দশমিক তিন ট্রিলিয়ন (এক লাখ ৩০ হাজার কোটি) ডলার। কোনো সমাধান না পাওয়ায় সম্মেলনের সময় একদিন বাড়ানো হয়। যদিও এটিকে বিশ্বাসঘাতকতা ও অপমানজনক বলে আখ্যায়িত করছে উন্নয়নশীল দেশগুলোসহ জলবায়ু কর্মীরা। র্দীঘ তত্রেশি ঘণ্টার আলোচনার পর সর্বশেষ জলবায়ু তহবিলে প্রতিবছর ৩০০ বিলিয়ন ডলার দিতে রাজি হয়েছে ধনী দেশগুলো। উন্নয়নশীল দেশগুলোকে নিম্ন-কার্বন অর্থনীতিতে রূপান্তর এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় ২০৩৫ সাল পর্যন্ত এই অর্থ দেওয়া হবে।
এদকিে ক্ষতিগ্রস্ত ছোট দ্বীপ রাষ্ট্রগুলো ৩০০ বিলিয়ন ডলারের এই অঙ্গীকারকে দুর্বল পদক্ষেপ মনে করে হতাশা প্রকাশ করে। তাদের দাবি, জলবায়ু ঝুঁকি মোকাবিলায় আরো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। তবে জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে সরে আসার বিষয়ে কোনো চুক্তি হয়নি।
‘সবুজ পৃথিবীর সঙ্গে সংহতি’ শ্লোগানকে সামনে রেখে এই সম্মেলনে অংশ নেন রাষ্ট্রপ্রধান, বিজ্ঞানী, নীতিনির্ধারক, ব্যবসায়ী এবং উদ্যোক্তারা। যদিও যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ফ্রান্সের মতো বড় কার্বন নিঃসরণকারী দেশগুলোর রাষ্ট্রপ্রধানরা অনুপস্থিত ছিলেন, তাদের উপস্থিতি এই আলোচনায় বিশেষ গুরুত্ব বহন করতো।
এ সম্মেলনের ফলাফলে খুশি নয় উন্নয়নশীল দেশগুলোসহ জলবায়ু কর্মীরা। অবশ্য শুরুতেই শঙ্কা ছিল। জীবাশ্ম জ্বালানি নির্ভর অর্থনীতির উপর দাঁড়িয়ে থাকা দেশগুলো যখন আয়োজক হচ্ছে তখন জনমনে সন্দেহ ও শঙ্কা তৈরি হয়। বাকুর ক্ষেত্রে মানবাধিকার লংঘনের অভিযোগও তুলেছেন অনেকে। ‘ফ্রাইডেজ ফর ফিউচার’ আন্দোলনের গ্রেটা থুনবার্গসহ বহু মানবাধিকার ও জলবায়ুকর্মী আজারবাইজানে জলবায়ু সম্মেলন আয়োজনের প্রতিবাদ জানিয়েছেন। দুনিয়াজুড়ে বহু অমীমাংসিত তর্ক আছে, ‘জলবায়ু তহবিল’ এমনি আরেক অমীমাংসিত বৈশ্বিক তর্ক। গ্রেটা থুনবার্গ জর্জিয়ার রাজধানী তিবিলিসিতে প্রতিবাদ মিছিলেও অংশ নেন। ২১ বছর বয়সী গ্রেটা থুনবার্গ এবং মিছিলে অংশ নেওয়া।
অন্য পরিবেশকর্মীরা বলেন, নিপীড়নমূলক নীতির কারণে জলবায়ু সম্মেলনের আয়োজক হওয়ার যোগ্য নয় দেশটি। তার কারণ হলো বিশ্বের অন্যতম জ্বালানি তেল উত্তোলনকারী দেশ আজারবাইজান। থুনবার্গের অভিযোগ, আজারবাইজান একটি নিপীড়ক ও দখলদার রাষ্ট। দেশটি জাতিগত নিধন অভিযান চালিয়েছে। নাগরিক সমাজের ওপর ক্রমাগত দমনপীড়ন চালিয়ে যাচ্ছে। থুনবার্গ এক্সে (সাবেক টুইটার) লেখেন, জলবায়ু সংকটের কারণে বিপুল সংখ্যক জীবন ধ্বংস হয়ে গেছে বা হবে, যারা ক্ষমতায় আছেন তাদেও কারণে অগণিত মানুষ মৃত্যুমুখে পতিত হতে চলেছে। জলবায়ু সংকটে যেমন মানুষের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে, তখনো সারা বিশ্বে নিপীড়ন, অসমতা, যুদ্ধ এবং গণহত্যা তীব্রতর হচ্ছে। যারা ক্ষমতায় আছে তারা আমাদের জীবন সহায়ক ইকোসিস্টেম আরো অস্থিতিশীলতা ও ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
বিশ্বব্যাপী গ্রিন হাউজ গ্যাস গত বছরও সর্বকালের সর্বোচ্চ মাত্রায় পৌঁছেছে। এটি স্পষ্ট যে বর্তমান সিস্টেমগুলো আমাদের পক্ষে কাজ করছে না। কপের প্রক্রিয়াগুলো কেবল আমাদের ব্যর্থ করছে না, এর কারণে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে খেসারত দিতে হবে। আজারবাইজানে ওই সম্মেলন সমঝোতার জন্য অতিরিক্ত ৩৩ ঘণ্টা সময় লেগেছে। জাতিসংঘ জলবায়ু সংস্থার প্রধান সাইমন স্টেইল বলেছেন, ‘এটি ছিল কঠিন যাত্রা কিন্তু আমরা চুক্তিটি করতে পেরেছি।’ যদিও জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে সরে আসার জন্য দেশসমূহের প্রতি যে আহ্বান গত বছর করা হয়েছিলো সে বিষয়ে কোনো চুক্তি এবারের সম্মেলনে করা যায়নি।
উন্নতদেশগুলো, বিশেষত জলবায়ু ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলো নাটকীয়ভাবে আলোচনা থেকে বেরিয়ে এসেছিলো। ছোট ছোট দ্বীপ রাজ্যগুলোর যে জোট তার প্রধান সেডিরক সুসটার বলেন, ‘আমি এটি বাড়িয়ে বলছি না যে আমাদের দ্বীপগুলো ডুবে যাচ্ছে। একটি দুর্বল চুক্তি নিয়ে আমরা আমাদের নারী, পুরুষ ও শিশুদের কাছে ফেরত যাবো এটি আপনারা প্রত্যাশা করেন কী করে?’
ধনী দেশগুলোর জলবায়ু তহবিলে ৩০০ বিলিয়ন ডলার দেওয়ার প্রতিশ্রুতির বিপক্ষে সুইজারল্যান্ড, মালদ্বীপ,কানাডা ও অস্ট্রেলিয়াসহ কিছু দেশ প্রতিবাদ জানায়। তারা বলছে জীবাশ্ম জ্বালানির বৈশ্বিক ব্যবহার কমিয়ে আনার জন্য চুক্তিতে যে ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে তা খুবই দুর্বল। এদিকে চলতি বছরও গরম আবহাওয়ার রেকর্ড গড়েছে। সঙ্গে নিয়মিতই দেখা গেছে দাবদাহ ও প্রাণঘাতী ঝড়।
এবারের সম্মেলনে আলোচনার শুরুতে ১১ নভেম্বর বেশি কথা হয়েছে ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাচন নিয়ে। তিনি জানুয়ারিতে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নিবেন। তিনি জলবায়ু নিয়ে সন্দেহবাদী মানুষ, যিনি যুক্তরাষ্ট্রকে প্যারিস চুক্তি থেকে সরিয়ে নিবেন বলেছিলেন। ২০১৫ সালের ওই চুক্তি জলবায়ু সংকট মোকাবেলার ক্ষেত্রে দেশগুলোকে একটি পথনকশা দিয়েছিলো।
জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ও ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জোয়ানা ডেপ্লেজ বলেন, অন্য উন্নত দাতা দেশগুলো প্রকৃত অর্থে জানে যে ডোনাল্ড ট্রাম্প একটি পয়সাও দেবে না। তবে চুক্তিতে উপনীত হওয়ার অর্থ হলো দেশগুলো জলবায়ু বিষয়ে এক হয়ে কাজ করতে এখনো অঙ্গীকারাবদ্ধ। তবে বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশটি এর অংশ হতে চাইছে না, যা কয়েক বিলিয়ন ডলার মূল্যের লক্ষ্য অর্জনকে কঠিন করে তুলবে।
যুক্তরাজ্যের জ্বালানি মন্ত্রী এড মিলিব্যান্ড বলেছেন, নতুন প্রতিশ্রুতির অর্থ এই নয় যে যুক্তরাজ্য আরো অর্থ নিয়ে এগিয়ে আসবে, তবে ব্রিটিশ ব্যবসার জন্য অন্য বাজারগুলোতে বিনিয়োগের একটি বড় সুযোগ। জলবায়ুর জন্য এটি শেষ মুহূর্তের একটি কঠিন চুক্তি। আমি বা আমরা যা চাই, তার জন্য এটিই সব নয় তবে সবার জন্য এটি এক ধাপ এগিয়ে যাওয়া। আর বেশি অর্থের অঙ্গীকারের বিনিময়ে যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো চাইছে দেশগুলো জীবাশ্ম জ্বালানি কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে আরো জোরালো অঙ্গীকার করুক।
সম্মেলনের প্রথম দিনে, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি আশা করা হয়েছিল। প্যারিস চুক্তির আওতায় জলবায়ু অর্থায়ন, অভিযোজন এবং বৈশ্বিক মূল্যায়নে গুরুত্ব দেওয়া হয়। প্রায় ২০০ দেশের নেতারা দরিদ্র দেশগুলো আরো অর্থ সহায়তা প্রদানের উপায় নিয়ে আলোচনা করেছেন। ইউএনইপি রিপোর্টে বলা হয়, উন্নয়নশীল দেশগুলোর বর্তমান জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় দৈনিক এক বিলিয়ন ডলার প্রয়োজন, তবে তারা পাচ্ছে মাত্র ৭৫ মিলিয়ন ডলার।
জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস একে সংকট বলে উল্লেখ করেন এবং দ্রুত অভিযোজনের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন। সম্মেলনের প্রেসিডেন্ট মুখতার বাবায়েভ কপ-২৯-কে ‘প্যারিস চুক্তির সত্যের মুহূর্ত’ বলে অভিহিত করেন। জাতিসংঘর জলবায়ু প্রধান সাইমন স্টিয়েল জলবায়ু সংকটে দুর্বল দেশগুলোর ক্ষতির কথা তুলে ধরেন। কপ-২৯ এ নতুন বৈশ্বিক আর্থিক লক্ষ্য নির্ধারণ এবং কার্বন বাজারের নিয়ম চূড়ান্ত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তবে জীবাশ্ম জ্বালানি সংস্থাগুলোর ভূমিকা ও স্বার্থের দ্বন্দ্ব আলোচনার ফলাফলকে বাধাগ্রস্ত করেছে। তবে ট্রাম্পের পুনঃনির্বাচনের সম্ভাবনা মার্কিন জলবায়ু নীতির জন্য চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে বলে বিশেষজ্ঞরা মত প্রকাশ করেন।
র্জামানরি পররাষ্ট্রমন্ত্রী আনালনো বয়োরবক সামাজকি মাধ্যম এক্স-এ র্দীঘ একটি পোস্ট দয়িছেনে৷ তাতে তনিি লখিছেনে, ‘এটা ঠকি যে কারো কারো প্রতরিোধরে কারণে আজকে রাতরে এই চুক্তটিি যথষ্টে হয়ন৷ি যারা এখানে অগ্রযাত্রা থামাত,ে জলবায়ু ন্যায্যতাকে রুখতে এবং আমাদরে জাতসিংঘরে বহুপাক্ষকি ব্যবস্থাকে র্দুবল করতে এসছেলিনে তারা খুবই বাজভোবে হরেে গছেনে৷ ঐতহিাসকি দায় কউে ভুলে যায়ন৷ি তরুণ প্রজন্মরে সদস্য হসিবেে এটা পরষ্কিার : আমরা অতীতরে সমাধান দয়িে ভবষ্যিতরে জলবায়ু চ্যালঞ্জে মোকাবলিা করতে পারবো না৷ আমরা জানি আজকে শুধু আমাদরে সদ্ধিান্ত দয়িে সব প্রয়োজন মটোনো যাবে না৷’ ঝুঁকতিে থাকা দশেগুলোকে তারা ত্যাগ করনেনি বলে জানান বয়োরবক৷ তার মতে র্বাষকি ৩০ হাজার কোটি ডলাররে চুক্তটিি কবেল সূচনা৷
ইউরোপীয় ইউনিয়নের জলবায়ু কমিশনার ভপকে হুকস্ট্রা মনে করেন, তহবিলের অঙ্ক ট্রিলিয়ন ডলার না হলেও তা প্রথম পদক্ষেপ মেটানোর মতো। তিনি বলেন, আমরা আত্মবিশাসী যে এই তহবিল এবং কাঠামো দিয়ে এক দশমিক তিন ট্রিলিয়ন ডলারের (লক্ষ্যমাত্রায়) পৌঁছাতে পারবো।
কপ-২৯ এর দ্বিতীয় দিন সিভিল সোসাইটি গ্রুপগুলো কার্বন বাজারের ট্রেডিং প্রক্রিয়া নিয়ে সমালোচনা করেছে। তারা মনে করেছিল, এই প্রক্রিয়া দক্ষিণের দরিদ্র জনগোষ্ঠী, আদিবাসী এবং ক্ষুদ্র কৃষকদের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে।
গ্লোবাল উইটনেসের তথ্য মতে, ২০২২ সালে তেল ও গ্যাস শিল্প চার ট্রিলিয়ন ডলার মুনাফা করেছিল, যা জলবায়ু ক্ষতির বার্ষিক ব্যয়ের ১০ গুণ। তবে জাতিসংঘের লস অ্যান্ড ড্যামেজ তহবিলে এটির শূন্য দশমিক দুই শতাংশেরও কম বরাদ্দ হয়েছিল। মার্কিন দূত জন পোডেস্টা (ঔড়যহ চড়ফবংঃধ) দাবি করেছিলেন, ডোনাল্ড ট্রাম্পের জলবায়ু নীতি মন্থর করলেও তা স্থগিত করা যাবে না। বিদায়ী প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের আইআরএ আইন ক্লিন এনার্জি খাতে বিনিয়োগ চালিয়ে যাবে।
ইউএনএইচসিআরের এক প্রতিবেদনে জলবায়ু সংকটের কারণে বাস্তুচ্যুত ১২০ মিলিয়ন মানুষের দুর্দশা প্রকাশিত হয়। যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার (কবরৎ ঝঃধৎসবৎ) ২০৩৫ সালের মধ্যে ৮১ শতাংশ কার্বন নির্গমন কমানোর ঘোষণা দেন। কাজাখস্তান ২০৬০ সালের মধ্যে কার্বন নিরপেক্ষতা অর্জনের প্রতিশ্রুতি দেয়।
কপ-২৯ জলবায়ু সম্মেলনের তৃতীয় দিনে প্রকাশিত তথ্যে জানা যায়, ২০২৪ সালে জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে নির্গমন ২০১৫ সালের তুলনায় আট শতাংশ বেশি হবে, যদিও নির্গমন কমানোর প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। ২০২৩ সালে কপ ২৮-এ দেশগুলো নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিকে এগিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেও বাস্তবে পরিবর্তনের লক্ষণ দেখা যায়নি।
এক দশমিক পাঁচ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা লক্ষ্যমাত্রা ধরে রাখতে এখনো সুযোগ আছে, তবে দ্রুত পদক্ষেপ জরুরি। এ সময় উন্নয়নশীল দেশগুলোর নেতারা জলবায়ু তহবিল বাড়িয়ে এক দশমিক তিন ট্রিলিয়ন ডলার করার প্রস্তাব দেন। সুইডেন লস অ্যান্ড ড্যামেজ তহবিলে ২০ মিলিয়ন ডলার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ২০৩৫ সালের মধ্যে ৮১ শতাংশ নির্গমন কমানোর লক্ষ্য ঘোষণা করেন এবং ১০০ শতাংশ ক্লিন এনার্জি সরবরাহ নিশ্চিতের পরিকল্পনা করেন।
জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস (অহঃষ্টহরড় এঁঃবৎৎবং) বলেন, ২০২৪ সাল সবচেয়ে উষ্ণ বছর হতে পারে, তবে ক্লিন এনার্জির বিপ্লব থামবে না। স্পেনের প্রধানমন্ত্রী পেদ্রো সানচেজ (চবফৎড় ঝপ্সহপযবু) জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দুর্যোগের তীব্রতা কমানোর ওপর জোর দেন। ২৬-তম গ্লাসগো সম্মেলনে লস অ্যান্ড ড্যামেজ ফান্ড কার্যকর করার আলোচনা শুরু হলেও ২৯-তম কপ সম্মেলনেও তা বাস্তবায়নে কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি হয়নি। এবারের কপকে ‘ক্লাইমেট ফাইন্যান্স কপ’ নামে অভিহিত করা হলেও উন্নত দেশগুলো ট্রিলিয়ন ডলারের তহবিল নিয়ে একমত হয়নি।
আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্ট জাভিয়ের মিলেই (ঔধারবৎ গরষবর) জলবায়ু সংকটকে ‘সমাজতান্ত্রিক মিথ্যা’ বলে উল্লেখ করে কপ-২৯ থেকে তার প্রতিনিধিদেও প্রত্যাহারের নির্দেশ দেন, যা আর্জেন্টিনার বাণিজ্যিক ও পরিবেশগত অবস্থান ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। ফ্রান্সকে নিয়ে আজারবাইজানের রাষ্ট্রপতির মন্তব্যের পর ফ্রান্সের পরিবেশ মন্ত্রী সম্মেলনে যোগদান বাতিল করেন। কপ-২৯ এ আর্থিক আলোচনা ধীরগতিতে এগিয়েছে, যা ১০০ বিলিয়ন ডলারের প্রতিশ্রুতি প্রতিস্থাপনে ব্যথ। জীবাশ্ম জ্বালানির ভর্তুকি এক দশমিক সাত ট্রিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে, যা নবায়নযোগ্য শক্তির অগ্রগতিতে বাধা সৃষ্টি করছে।
কপ-২৯ এর প্রধান লক্ষ্য ছিল লস অ্যান্ড ড্যামেজ ফান্ড গঠন, নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি এবং বৈশ্বিক তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপ নেওয়া। তবে এই লক্ষ্যগুলোর বাস্তবায়নে তেমন কোনো পদক্ষেপ দেখা যায়নি। জীবাশ্ম জ্বালানি উৎপাদনকারী দেশগুলো এই সম্মেলনে বেশি প্রভাব ফেলেছে এবং ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর জন্য ক্ষতিপূরণের সম্ভাবনা কমে গেছে। পরবর্তী সম্মেলনে, ধনী দেশগুলো লস অ্যান্ড ড্যামেজ ফান্ডে অর্থায়ন করবে কিনা তা এখন বড় প্রশ্ন।
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলন শুধুমাত্র সেই দেশগুলোয় অনুষ্ঠিত হওয়া উচিত যারা জীবাশ্ম জ্বালানি লবিংয়ের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেয়। কপ-২৯ এ জীবাশ্ম জ্বালানি লবিস্টদের উপস্থিতি ব্যাপক ছিল, যার মধ্যে ১৩২টি জীবাশ্ম জ্বালানি কোম্পানির প্রতিনিধিকে অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। জীবাশ্ম জ্বালানি সংশ্লিষ্ট প্রায় এক হাজার ৭৭৩ জন লবিস্ট সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেছিল, যা অন্যান্য দেশের প্রতিনিধিদের তুলনায় অনেক বেশি।
দিল্লি ভিত্তিক সেন্টার ফর সায়েন্স অ্যান্ডএনভায়রনমেন্টের তথ্য অনুযায়ী, ১৮৭০ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য, জাপান, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়া বিশ্ব জনসংখ্যার ১৫ শতাংশ ধারণ করলেও বায়ুমণ্ডলে প্রায় ৬০ শতাংশ কার্বন-ডাই-অক্সাইড নির্গমনে অবদান রেখেছে। ধনী দেশগুলোর জলবায়ু ঋণের পরিণতি দরিদ্র দেশগুলোর জন্য বিশাল বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কপ-২৯ এর আয়োজক আজারবাইজান জীবাশ্ম জ্বালানি উৎপাদনকারী দেশগুলো বেশি প্রাধান্য দিয়েছে, যার ফলে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর ক্ষতিপূরণ আদায়ের সম্ভাবনা কমে গেছে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, জলবায়ু সম্মেলন ভবিষ্যতে কেবল সেই দেশগুলোয় হওয়া উচিত যারা জলবায়ু পরিবর্তন রোধে সক্রিয় ভূমিকা রাখে।
এবারো হতাশাজনক ফলাফল নিয়ে শেষ হয়েছে কপ-২৯ সম্মেলন। ৮৫ হাজার প্রতিনিধি অংশগ্রহণ করলেও, সম্মেলন শেষে লস অ্যান্ড ড্যামেজ ফান্ড, নতুন যৌথ পরিমাণগত লক্ষ্য (এনসিকিউজি) ইত্যাদির মতো বিষয়গুলোয় ঐকমত্যে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। তহবিল বরাদ্দ ও তহবিলের কাঠামো নিয়ে তীব্র বিতর্ক সৃষ্টি হয় এবং উন্নয়নশীল দেশগুলো অভিযোগ করে যে, ধনী দেশগুলো তাদের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থায়ন থেকে পিছু হটেছে। ২৫০ বিলিয়ন ডলারের বরাদ্দ উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য যথেষ্ট ছিল না। পাশাপাশি, কপ-২৯ এ তহবিলের খসড়া প্রস্তাবও প্রত্যাখ্যাত হয়। এ সময় কপ-৩০ এ জলবায়ু অর্থায়ন ও তহবিলের কার্যকর ব্যবস্থার জন্য দক্ষিণের দেশগুলো ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানায়।
জাতিসংঘের ২৯-তম জলবায়ু সম্মেলনের আলোচনা থেকে বোঝা গেছে, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক নীতিমালা ও সহযোগিতার ক্ষেত্রে এখনো অনেক ত্রুটি রয়ে গেছে। বিশেষত, কার্বন বাজারের আর্টিকেল ৬-এর অধীনে নির্গমন হ্রাসের নিয়ম প্রণয়নে স্বচ্ছতার অভাব এবং কার্যকর জবাবদিহির ঘাটতি ছিল স্পষ্ট। কার্বন বাজারের জন্য প্রস্তাবিত নিয়মগুলো আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মানসম্পন্ন কার্বন ক্রেডিট বাণিজ্যের নিশ্চয়তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে, যা জলবায়ু পরিবর্তনের কার্যকর সমাধানকে দুর্বল করেছে।
প্যারিস চুক্তি সত্ত্বেও উন্নত দেশগুলোর সহযোগিতার অভাব এবং জলবায়ু অর্থায়নে অগ্রগতির ধীরগতি, সম্মেলনের সফলতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। ২০২৩ সালে ৫৭ দশমিক চার গিগাটন গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমনের তথ্য জলবায়ু সংকটের ভয়াবহতা আরো স্পষ্ট করেছে। ফলে দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশগুলো বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
ভারতের প্রতিনিধি চাঁদনি রায়না বলেন, এশিয়ান দেশগুলো চুক্তি প্রত্যাখ্যান করছে। আমরা এই ফলাফলে হতাশ। কারণ উন্নত দেশের দলগুলো স্পষ্টতই তাদের দায়িত্ব পালনে অনিচ্ছা প্রকাশ করছে। আমি দুঃখের সঙ্গে বলতে চাই এই নথিটি একটি বিভ্রম ছাড়া আর কিছু না। আমরা যে বিশাল চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছি তার সমাধান এটি করবে না। তাই, এই নথি গ্রহণে বিরোধিতা করছি আমরা।
অন্যদিকে, দ্বীপদেশ মালাওয়ির কূটনীতিক এবং স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জোট এলডিসির প্রধান বলেছেন, আমরা কী আশা করছি তা পাওয়া এখানে লক্ষ্য নয়। কয়েক বছরের আলোচনার পর আমরা আর এই নিয়ে উচ্চাভিলাষী নই।
বাকু জলবায়ু সম্মেলনে একেবারেই বিচ্ছিন্ন কিছু আলাপ হলেও ট্রান্সবাউন্ডারি জলবায়ু ব্যবস্থাপনাকে রাষ্ট্রপক্ষের মূল আলাপে আনা জরুরি। কারণ বাকু সম্মেলনে বহু দেশের মানুষ তাদের বহু অভিন্ন বাস্তুতন্ত্রেও জলবায়ু অভিজ্ঞতা নিয়ে কথা বলেছেন, যা- ট্রান্সবাউন্ডারি ব্যবস্থাপনা কাঠামো ছাড়া সামাল দেওয়া কঠিন। জলবায়ু অর্থায়নের ক্ষেত্রেও এই ট্রান্সবাউন্ডারি জলবায়ু ব্যবস্থাপনাকে গুরুত্ব দিতে হবে। ট্রান্সবাউন্ডারি লস অ্যান্ড ড্যামেজ পূরণে কিংবা অভিন্ন অভিযোজনের ক্ষেত্রে যখন দুটি বা কয়েকটি রাষ্ট্র মিলে একটি অভিন্ন ট্রান্সবাউন্ডারি জলবায়ু পরিকল্পনা করবে সেক্ষেত্রে অর্থায়ন ট্রান্সবাউন্ডারির সকল পক্ষ রাষ্ট্রকে সমানভাবে ও ন্যায্যতার দৃষ্টিতে বণ্টন করতে হবে। বাকু সম্মেলনে স্পষ্টভাবে ট্রান্সবাউন্ডারি জলবায়ু ব্যবস্থাপনা নিয়ে সিদ্ধান্ত না হলেও দক্ষিণ এশীয় সহযোগিতা এবং এমনকি সার্ক নিয়েও কিছু আলাপ এসেছে। বাংলাদেশ, নেপাল ও ভূটানের ভেতর আঞ্চলিক সহযোগিতা বাড়িয়ে জলবিদ্যুৎ, কৃষি, বন ও নদী ব্যবস্থাপনায় মনোযোগী হতে আহবান জানিয়েছে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশসহ জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলো প্রাকৃতিক দুর্যোগের মোকাবিলায় আর্থিক সহায়তা ও জলবায়ু সহনশীল প্রযুক্তি প্রয়োজনের কথা জানিয়েছে। সম্মেলনে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ওপর জোর দেওয়া হলেও জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা হ্রাসে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ হয়নি।
এদিকে বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশগুলো তহবিল থেকে ন্যায্য পাওনা কতটা পাবে, তা নিয়ে সন্দিহান তারা। ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলো নতুন ও অতিরিক্ত তহবিল, ঋণের বদলে অনুদান এবং সুস্পষ্ট তহবিলের দাবি করলেও সেগুলো উপেক্ষিত রয়ে গেছে এবারের সম্মেলনে।
সার্বিকভাবে, কপ-২৯ সম্মেলন কিছু প্রস্তাবনায় অগ্রগতি আনলেও কার্যকর পরিবর্তনের জন্য স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করার সুযোগ হাতছাড়া হয়েছে। উন্নত দেশগুলোর সক্রিয় ভূমিকা ছাড়া উন্নয়নশীল দেশগুলোর পক্ষে এই সংকট মোকাবিলা করা অসম্ভব।
লেখক : সাংবাদিক; অর্থ সম্পাদক, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন (ডিইউজে)।