সোহেলী চৌধুরী
নির্বাচন কমিশনের (ইসি) ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী আগামী ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচনি কার্যক্রম শুরু করে দিয়েছে আওয়ামী লীগ ও তার শরিকরা। তফসিল প্রত্যাখ্যান করে নির্বাচন প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়েছে বিরোধী দল বিএনপি ও তাদের মিত্ররা। সরকারের পদত্যাগ ও নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের এক দফা দাবিতে হরতাল-অবরোধসহ নানা কর্মসূচি নিয়ে মাঠে রয়েছে তারা। এ অবস্থায় তফসিল ঘোষণা হলেও রাজনৈতিক দলগুলোকে সংলাপের মাধ্যমে সংকট নিরসনের আহ্বান জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা হলে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের স্বার্থে ভোটের ঘোষিত তারিখ পেছাতে আপত্তি নেই কমিশনের। অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের স্বার্থে করণীয় সম্পর্কে আগে থেকেই প্রস্তুতি নিয়ে রাখা হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর বলেছেন, ‘বিএনপি নির্বাচনে এসে সহায়তা চাইলে অবশ্যই তা করা হবে। তবে রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের নয়। যেসব দল নির্বাচনে অংশ নেবে, তাদের জন্য যত রকম ইতিবাচক চেষ্টা করা সম্ভব, তা করা হবে। যারা নির্বাচনে আসবে না, তাদের ব্যাপারে আমাদের কিছু করার নেই।’
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘পুলিশ প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে কোনো অভিযোগ এলে এবং তা প্রমাণ হলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে অভিযোগ সুনির্দিষ্ট এবং তথ্যবহুল হতে হবে।’
নির্বাচনের পরিবেশ নেই- কয়েকটি রাজনৈতিক দলের এমন অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, চিরকাল সরকারি দল এবং বিরোধী দল পরস্পরের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে। এটা ১৯৭০ সাল থেকে দেখে আসছি।
বুধবার (১৫ নভেম্বর) জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণের মধ্য দিয়ে দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেন সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল। সংলাপের মাধ্যমে রাজনৈতিক মতভেদ সমাধান অসাধ্য নয় মন্তব্য করে সংঘাত পরিহার করে দলগুলোকে সমাধান খুঁজতে বলেন তিনি। এর আগেও রাজনৈতিক সংকট রাজনৈতিকভাবেই সমাধানের পরামর্শ দেন সিইসি। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হয়ে গেলেও রাজনৈতিক সমঝোতা হলে যে কোনো সিদ্ধান্তের জন্য তারা প্রস্তুত রয়েছে। সেক্ষেত্রে ভোটের তারিখ পেছাতেও সমস্যা নেই ইসির।
তফসিল ঘোষণার পর ইসিতে জোটবদ্ধ নির্বাচনের তথ্য জানিয়েছে ১০টি রাজনৈতিক দল। আওয়ামী লীগসহ কয়েকটি দল ইতিমধ্যেই মনোনয়ন ফরম বিক্রি শুরু করেছে। জাতীয় পার্টি-জাপাও এককভাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণের ইঙ্গিত দিয়েছে। দলটির প্রধান পৃষ্ঠপোষক বেগম রওশন এরশাদ রোববার (১৯ নভেম্বর) রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণাকে স্বাগত জানান। তবে প্রার্থীদের আয়কর রিটার্নের সুবিধার্থে মনোনয়ন জমা দেওয়ার সময় সাত দিন পিছিয়ে দেওয়ার দাবি করেন। এ সময় রাষ্ট্রপতি বিষয়টি দেখবেন বলে আশ্বস্ত করেছেন বলে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন রওশন এরশাদ।
এক দফা দাবি আদায়ে কর্মসূচি নিয়ে সরকারবিরোধী বিএনপি জোট এখন পর্যন্ত নির্বাচন বর্জনের জন্য মাঠে রয়েছে। চলমান সংকট নিরসনে শর্তহীন সংলাপের পরামর্শ দিয়ে বড় রাজনৈতিক দলগুলোকে তফসিল ঘোষণার ঠিক আগে চিঠি দেন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু। বিএনপির শর্তের কারণেই সংলাপ সম্ভব নয় বলে তার চিঠির জবাবে জানিয়েছে আওয়ামী লীগ। বিএনপিও চিঠি দিয়ে বলেছে, আবারও একতরফা নির্বাচন করার জন্যই ক্ষমতাসীনরা আলোচনায় রাজি নয়। তবে জাতীয় পার্টি সংলাপ ও সমঝোতার মাধ্যমে সমাধানের পক্ষে। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হয়ে গেলেও সংলাপের সম্ভাবনা শেষ হয়ে যায়নি বলে মনে করছেন নির্বাচন ও রাজনীতি বিশ্লেষকরা। সেজন্য দলগুলোর সদিচ্ছাই ও আন্তরিকতাই যথেষ্ট বলে মত তাদের।
ইসির একাধিক সূত্র জানায়, আগামী ২৯ জানুয়ারির মধ্যেই দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু ভোটের পরের সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করতে সপ্তাহখানেক সময়ই যথেষ্ট, যদিও ৭ জানুয়ারি ভোটের তারিখ ঘোষণা করা হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা হলে যাতে ভোটের তারিখ পেছানো যায়, সেটি বিবেচনায় রেখেই এ তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে। ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফশিল ঘোষণার পরও রাজনৈতিক সমঝোতার জন্য ভোটের তারিখ পিছিয়েছিল নির্বাচন কমিশন। এবারও সেই সুযোগ রাখা হয়েছে।
আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট গ্রহণ স্বচ্ছ করার পদ্ধতিগুলো নির্বাচন কমিশনের কাছে জানতে চেয়েছে কমনওয়েলথের প্রাক-নির্বাচন পর্যবেক্ষণ প্রতিনিধিদল। তবে ভোটের সময় কমনওয়েলথ থেকে পর্যবেক্ষক পাঠানো হবে কিনা তা নিশ্চিত করেনি। প্রতিনিধিদলের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, নির্বাচন পরিস্থিতি সম্পর্কে তাদের প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে এ বিষয়ে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। রোববার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে কমনওয়েলথের প্রতিনিধিদলের সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান নির্বাচন ইসি সচিব মো. জাহাংগীর আলম।
বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে তারা কী জানতে চেয়েছে-এমন প্রশ্নের জবাবে জাহাংগীর আলম বলেন, ‘রাজনৈতিক বা অন্য কোনো বিষয়ে আলোচনা হয়নি। তবে প্রতিনিধিদল বাংলাদেশের নির্বাচন পদ্ধতি, নির্বাচনের কর্মপদ্ধতি, নির্বাচনসংক্রান্ত আইনকানুন, বিধিবিধান, কীভাবে ভোটগ্রহণ হবে, ভোটাররা কীভাবে ভোট দিতে পারবেন, প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা, ভোটাররা ভোট দিতে কী কী সুযোগ-সুবিধা পাবেন, যারা নির্বাচনি কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকবেন বা বিদেশে যারা ভোটার আছেন, তাদের ভোট কীভাবে নেওয়া যাবে, পোস্টাল ব্যালট, নির্বাচনের দিনে যানবাহনসংক্রান্ত ব্যবস্থা -এসব বিষয়ে কমিশনের কাছ থেকে জানতে চেয়েছিল। প্রধান নির্বাচন কমিশনার ইসির পক্ষে তাদের বিস্তারিত সবকিছু জানিয়েছেন। তাতে তারা সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। এটি তাদের একটি পূর্ববর্তী বা অগ্রবর্তী দল। এই অগ্রবর্তী দল কমনওয়েলথে গিয়ে রিপোর্ট দেবে। রিপোর্ট দাখিলের পরে কমনওয়েলথের পূর্ণাঙ্গ টিম আমাদের নির্বাচন পর্যবেক্ষণের বিষয়ে সম্মতি জানাবে কি জানাবে না, তা পরে নির্ধারণ করবে।’
বৈঠক শেষে কমনওয়েলথের প্রতিনিধিদলের প্রধান (ইলেকটোরাল সাপোর্ট গভর্নেস অ্যান্ড পিস ডিরেক্টর) লিনফোর্ড অ্যানড্রিউস সাংবাদিকদের বলেন, ‘প্রি-ইলেকশন অ্যাসেসমেন্ট মিশনের অংশ হিসেবে আমরা এসেছি। যে কোনো সদস্য দেশেই কমনওয়েলথ ভোট পর্যবেক্ষক পাঠানোর আগে প্রাক-নির্বাচন পরিস্থিতি মূল্যায়ন প্রতিনিধি পাঠায়। আমরা মূলত নির্বাচনি প্রস্তুতি নিয়ে আলোচনা করেছি। তাছাড়া কমনওয়েলথ পর্যবেক্ষক পাঠালে নির্বাচন কমিশন কতটুকু সহায়তা দিতে পারবে, তা নিয়ে ভালো আলোচনা হয়েছে।’
চার সদস্যের এই প্রতিনিধিদলের অন্যরা হলেন- ইলেকটোরাল সাপোর্ট সেন্টারের পলিটিক্যাল অ্যাডভাইজার লিন্ডিউই মাললেকা, একজিকিউটিভ অফিসার জিপ্পি ওজাগো এবং অ্যাসিসটেন্ট রিসার্চ ফিসার সার্থক রায়।
সোমবার (২০ নভেম্বর) সাংবাদিকদের নির্বাচন কমিশনার রাশেদা সুলতানা বলেন, ‘এখনো যেসব রাজনৈতিক দল আসেনি তারা যদি আসতে চায় তাহলে আইন মেনে তাদের নির্বাচনে আসার পথ তৈরি করা হবে। বিএনপি নির্বাচনে আসার সিদ্ধান্ত নিয়ে কোনো ধরনের সহায়তা চাইলে তাতে ইতিবাচক সাড়া দেবে ইসি। যদি তারা নির্বাচনে আসতে চায় তাদের আমরা স্বাগত জানাব।’ রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা হলে ভোটের তারিখ পেছাতে আপত্তি নেই।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. হারুন-অর-রশিদ বলেন, ‘এবারের নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠ হতেই হবে। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের মতো আরেকটি নির্বাচনের বোঝা দেশের পক্ষে বহন করা সম্ভব নয়। তবে সরকারি দলের পক্ষ থেকে বিএনপির সঙ্গে বহুবার কথা বলার চেষ্টা করা হয়েছে। ২০১৪ সালের নির্বাচনে না গিয়ে বিএনপি সবচেয়ে বড় ভুলটা করেছে। এবার নির্বাচনে না যাওয়া হবে আরেকটা ভুল। সময় হাতে খুব কম। আওয়ামী লীগ তো নির্বাচনে জোয়ার তৈরি করে ফেলবেই, নতুন নতুন দলও নির্বাচনে আসবে।’