ঢাকা , মঙ্গলবার, ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

চিঠি চালাচালিতেই সীমাবদ্ধ রোকেয়ার দেহাবশেষ আনার প্রতিশ্রুতি : মুখ থুবড়ে পড়েছে জন্মভিটা ও স্মৃতিকেন্দ্রটি

  • ডেস্ক :
  • আপডেট সময় ০৫:৪৬ অপরাহ্ন, শনিবার, ৯ ডিসেম্বর ২০২৩
  • 195

সোহেলী চৌধুরী

আজ (৯ ডিসেম্বর) শনিবার রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের ১৪৩তম জন্ম ও ৯১তম মৃত্যুদিবস। ঘটনাটি বিরল হলেও বছরে একটি দিনই শুধু তাকে স্মরণ করার সুযোগ হয়। দিবসটি নিয়ে নানা আয়োজন থাকলেও রোকেয়ার জন্মস্থানে তার ভক্ত-অনুরাগীদের মন ভারাক্রান্ত। অযত্ন ও অবহেলায় পড়ে আছে তার স্মৃতিবিজড়িত জন্মভিটা। জীবন ও কর্ম নিয়ে গবেষণায় চালু থাকা স্মৃতিকেন্দ্রটিও মুখ থুবড়ে পড়েছে। কলকাতা থেকে পায়রাবন্দে রোকেয়ার দেহাবশেষ আনার উদ্যোগটিও চিঠি চালাচালিতেই সীমাবদ্ধ। এদিকে রোকেয়াকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে বলে অভিযোগ অনুরাগীদের। দিনটি কেবলই আনুষ্ঠানিকতা আর নানা আশ্বাসে কেটে যায়। অনুরাগীরা জানে না তাদের দীর্ঘদিনের প্রত্যাশার আলো কবে ফুটবে।

উনবিংশ শতকে নারীরা যখন অবরোধবাসিনী, সেই সময় নারীর পরাধীনতার বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছিলেন বেগম রোকেয়া। এই উপমহাদেশে নারীর যে অগ্রগতি তা অর্জনে রোকেয়ার দর্শন ও কর্ম প্রেরণার উৎস হিসাবে কাজ করেছে। ১৮৮০ সালের ৯ ডিসেম্বর রংপুরের পায়রাবন্দ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন। স্মৃতি ধরে রাখতে তার জীবন, দর্শন ও সাহিত্যকর্ম নিয়ে গবেষণার জন্য ১৯৯৭ সালের ২৮ জুন ‘বেগম রোকেয়া স্মৃতি কেন্দ্রের’ ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ৫ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এই স্মৃতি কেন্দ্র ২০০১ সালের ১ জুলাই আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হয়। এরপর বিএনপি ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে স্মৃতি কেন্দ্রটির কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। পরে ২০০৮ সালের পর আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে বাংলা একাডেমিকে দেখভালের দায়িত্ব দিলেও স্থবির হয়ে আছে স্মৃতি কেন্দ্রের কার্যক্রম। তিনজন কর্মকর্তা এবং ছয়জন কর্মচারী থাকলেও দেখা মেলেনা অধিকাংশদের।

সরেজমিনে রোকেয়া স্মৃতি কেন্দ্র ঘুরে দেখা যায়, লাইব্রেরিতে সামান্য কিছু বই থাকলেও বাড়েনি সংগ্রহ। রয়েছে পর্যাপ্ত জনবলের অভাব। এদিকে দীর্ঘদিন ধরে সংস্কার না করায় ভবনের বিভিন্ন স্থানে ফাটল ধরেছে। নষ্ট হয়ে যাচ্ছে মূল্যবান অনেক জিনিসপত্র। অত্যাধুনিক অডিটোরিয়ামের আসবাবপত্র নষ্ট হয়ে গেছে। একই অবস্থা বেগম রোকেয়ার বাস্তুভিটাতেও। আজ অবধি সেখানে কোনো স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়নি। এতে আনাগোনা নেই দর্শনার্থীদের।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ২০০৯ সালের ৯ ডিসেম্বর রোকেয়া মেলার আলোচনাসভায় তার ভাতিজি রনজিনা সাবের দাবি তোলেন বেগম রোকেয়ার দেহাবশেষ কলকাতা থেকে ফিরিয়ে আনার। রংপুরের তত্কালীন জেলা প্রশাসক বি এম এনামুল হক দাবিটির প্রতি একাত্মতা ঘোষণা করে উদ্যোগ নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন।

২০১০ সালে একই স্থানে বি এম এনামুল হক বলেছিলেন, রোকেয়ার দেহাবশেষ পায়রাবন্দে আনার ব্যাপারে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন দপ্তরে আবেদন করা হয়েছে। ২০১১ সালের রোকেয়া দিবসের আগে তার দেহাবশেষ পায়রাবন্দে আসবে। এ ঘোষণায় সেদিন পায়রাবন্দবাসী আনন্দিত হয়েছিল। এরপর পেরিয়ে গেল এক দশক। এ ব্যাপারে আর কোনো উদ্যোগ নেয়নি জেলা প্রশাসন।

পায়রাবন্দ সরকারি বেগম রোকেয়া স্মৃতি মহাবিদ্যালয়ের উচ্চ মাধ্যমিক পড়ুয়া কয়েকজন শিক্ষার্থী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, শুধু ৯ ডিসেম্বর এলেই আমাদের মনে পড়ে রোকেয়া নামে এখানে কেউ একজন ছিলেন। কিন্তু দিবসটি পার হলেই আমরা তাকে আর স্মরণ করি না। আমাদের ইচ্ছা, আমরা রোকেয়ার কবরে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাব। কিন্তু ভারত থেকে তার দেহাবশেষ আনার কোনো উদ্যোগ নেই। দিন দিন রোকেয়ার ভিটেমাটি ও সম্পত্তিও বেহাত হয়ে যাচ্ছে। সব মিলিয়ে আগামী প্রজন্মের মধ্যে রোকেয়ার স্মৃতি বাঁচিয়ে রাখতে সরকারকে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।

পায়রাবন্দ বেগম রোকেয়া স্মৃতি সংসদের সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম দুলাল বলেন, বিবিসির জরিপে বিশ্বসেরা ২০ নারীর তালিকায় বেগম রোকেয়ার স্থান ৬ নম্বরে। অথচ তার দেহাবশেষ দেশে আনতে বছরের পর বছর গুনতে হচ্ছে। এটা দুঃখজনক। তৎকালীন জেলা প্রশাসকের প্রতিশ্রুতি এখনও চিঠি চালাচালিতেই সীমাবদ্ধ। বেগম রোকেয়াকে নিয়ে দেশে কাঠামোগত কিছু পরিবর্তন এসেছে। যেমন রোকেয়া স্মৃতিকেন্দ্র নির্মাণ, রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাসহ রোকেয়ার নামে সরকারি-বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও বিভিন্ন স্থাপনা রয়েছে। কিন্তু রোকেয়ার দর্শন ও চেতনাকে মনের মধ্যে লালন করা হচ্ছে না। স্মৃতিকেন্দ্রের পাঠাগারে রোকেয়া সম্পর্কিত দুটি বইপুস্তকও নেই। রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়েও রোকেয়াকে নিয়ে গবেষণা, পড়াশোনা হয় না। যার নামে বিশ্ববিদ্যালয় তার স্মৃতিস্মরণে ভাস্কর্যও নেই। রোকেয়ার বাস্তুভিটাকে প্রত্নসম্পদে পরিণত করতে কোনো উদ্যোগ নেই। আমার কাছে মনে হয়, এখন যা হচ্ছে, তা রোকেয়াকে ধারণ করে নয়, বরং এটা শুধুই আনুষ্ঠানিকতা। এ সময় নীতিনির্ধারকরা বিষয়টিকে গুরুত্ব দিচ্ছেন না বলে অভিযোগ করেন তিনি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. তুহিন ওয়াদুদ বলেন, ‘রোকেয়া কখনোই তার নামের আগে বেগম শব্দটি লিখেননি। কিন্তু সকলের কাছে বেগম শব্দটি প্রচলিত করে ফেলেছি। আমাদের এগিয়ে চলার পথে রোকেয়াচর্চা এ সময়ে খুবই প্রাসঙ্গিক। এ কারণে সকলের মাঝে বেগম শব্দটি যে ভুল ব্যবহার হচ্ছে, সেটি জানান দিয়ে সঠিকভাবে রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন নাম উপস্থাপিত হওয়া উচিত।’

রোকেয়া স্মৃতিকেন্দ্রের ইনচার্জ আবিদ করিম মুন্না বলেন, নতুন একটি প্রকল্পের মাধ্যমে স্মৃতিকেন্দ্রে বন্ধ থাকা বৃত্তিমূলক সেলাই প্রশিক্ষণ চালু করাসহ নারীদের আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টিতে নানা পদক্ষেপ নেওয়া হবে। সেই লক্ষ্যে প্রস্তাবনা তৈরি করা হচ্ছে। পাশাপাশি বেগম রোকেয়ার জীবন, সাহিত্য, কর্ম-দর্শন ব্যাপক প্রচার-প্রসারের লক্ষ্যে বাংলা একাডেমি থেকে আরো কিছু উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এই স্মৃতিকেন্দ্রটি আরো আধুনিক করা হবে। গবেষকদের জন্য বিশেষায়িত একটি গবেষণামূলক পাঠাগার ও ডরমিটরি করা হবে। এতে বিভিন্ন এলাকা থেকে আগত শিক্ষার্থী, দর্শনার্থী, গবেষক ও পর্যটকরা উপকৃত হবেন। আশা করছি, দ্রুত সময়ের মধ্যে রোকেয়া স্মৃতিকেন্দ্রটি আবারও প্রাণবন্ত হয়ে উঠবে।

বাংলা একাডেমির পরিচালক ডা. কে এম মোজাহেদুল ইসলাম বলেন, বর্তমানে প্রকল্পটি পরিকল্পনা কমিশনের সবুজ পাতায় তালিকাভুক্ত হয়েছে। ২০২৩ জুলাই থেকে ২০২৬ অর্থবছরের মধ্যে এটি বাস্তবায়নের কথা রয়েছে। স্থাপত্য অধিদপ্তর নকশা  প্রণয়ন করবে। রোকেয়া স্মৃতি সংসদের সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম দুলাল জানান, গত ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে স্মৃতিকেন্দ্রকে বিকেএমই গার্মেন্টস প্রশিক্ষণ কেন্দ্র করা হয়। সেনাসমর্থিত সরকার চলে যাওয়ার পর এটি দখলমুক্ত করে রোকেয়া চর্চার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করার দাবি থাকলেও বাস্তবে তেমন কিছু হয়নি।

মিঠাপুকুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শাহরিয়ার রহমান বলেন, জেলা প্রশাসনের সভায় বেগম রোকেয়া স্মৃতিকেন্দ্র চালুর পাশাপাশি সোদপুরে থাকা রোকেয়ার কবরটি আনার ব্যাপারে আলোচনা হয়েছে। বেগম রোকেয়া শুধু মিঠাপুকুর বা পায়রাবন্দের নন, তিনি সারা বাংলাদেশের। তিনি নারী জাগরণের অগ্রদূত ছিলেন। তার  বাস্তুভিটা এবং সম্পত্তি নিয়ে দুটি মামলা চলমান রয়েছে। আমরা সরকারের পক্ষ থেকে ইতিমধ্যে আদালতে একটা জবাব দিয়ে দিয়েছি। আমরা চেষ্টা করছি সেগুলো মনিটর করার। একই সঙ্গে ভারতের সোদপুরে থাকা বেগম রোকেয়ার কবরটি বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারেও কথাবার্তা হচ্ছে। এটি দুটি রাষ্ট্রের সরকার পক্ষের কূটনৈতিক বিষয়।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফাতেমাতুজ জোহরা বলেন, ‘রোকেয়া স্মৃতিকেন্দ্রের কার্যক্রম পুনরায় চালু করা ও বাস্তুভিটা সংরক্ষণের জন্য সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক মহোদয়কে অবগত করেছি। দ্রুতই এসবের বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন তিনি।

প্রসঙ্গত- বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন ১৮৮০ সালের ৯ ডিসেম্বর রংপুর জেলার মিঠাপুকুর উপজেলার পায়রাবন্দ গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। সে সময় মুসলিম সমাজে মেয়েদের লেখাপড়া শেখানোর কোনো চল ছিল না। তাই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকলেও পরিবারের সবার অগোচরে তার বড় ভাইয়ের কাছে উর্দু, বাংলা, আরবি ও ফারসি পড়তে এবং লিখতে শেখেন। তার জীবনে শিক্ষালাভ ও মূল্যবোধ গঠনে তার ভাই ও বড় বোন উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছিলেন। পরে বিহারের ভাগলপুরে সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে বিয়ে হয়। স্বামীর উত্সাহে ও নিজের আগ্রহে তিনি লেখাপড়ার প্রসার ঘটান। বেগম রোকেয়া ১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বর মারা যান। তিনি প্রাবন্ধিক, ঔপন্যাসিক, সাহিত্যিক ও সমাজ সংস্কারক হিসেবে পরিচিত। তার উল্লেখযোগ্য রচনা হলো ‘মতিচূর’, ‘সুলতানার স্বপ্ন’, ‘পদ্মরাগ’, ‘অবরোধ-বাসিনী’ ইত্যাদি।

ট্যাগস

চিঠি চালাচালিতেই সীমাবদ্ধ রোকেয়ার দেহাবশেষ আনার প্রতিশ্রুতি : মুখ থুবড়ে পড়েছে জন্মভিটা ও স্মৃতিকেন্দ্রটি

আপডেট সময় ০৫:৪৬ অপরাহ্ন, শনিবার, ৯ ডিসেম্বর ২০২৩

সোহেলী চৌধুরী

আজ (৯ ডিসেম্বর) শনিবার রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের ১৪৩তম জন্ম ও ৯১তম মৃত্যুদিবস। ঘটনাটি বিরল হলেও বছরে একটি দিনই শুধু তাকে স্মরণ করার সুযোগ হয়। দিবসটি নিয়ে নানা আয়োজন থাকলেও রোকেয়ার জন্মস্থানে তার ভক্ত-অনুরাগীদের মন ভারাক্রান্ত। অযত্ন ও অবহেলায় পড়ে আছে তার স্মৃতিবিজড়িত জন্মভিটা। জীবন ও কর্ম নিয়ে গবেষণায় চালু থাকা স্মৃতিকেন্দ্রটিও মুখ থুবড়ে পড়েছে। কলকাতা থেকে পায়রাবন্দে রোকেয়ার দেহাবশেষ আনার উদ্যোগটিও চিঠি চালাচালিতেই সীমাবদ্ধ। এদিকে রোকেয়াকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে বলে অভিযোগ অনুরাগীদের। দিনটি কেবলই আনুষ্ঠানিকতা আর নানা আশ্বাসে কেটে যায়। অনুরাগীরা জানে না তাদের দীর্ঘদিনের প্রত্যাশার আলো কবে ফুটবে।

উনবিংশ শতকে নারীরা যখন অবরোধবাসিনী, সেই সময় নারীর পরাধীনতার বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছিলেন বেগম রোকেয়া। এই উপমহাদেশে নারীর যে অগ্রগতি তা অর্জনে রোকেয়ার দর্শন ও কর্ম প্রেরণার উৎস হিসাবে কাজ করেছে। ১৮৮০ সালের ৯ ডিসেম্বর রংপুরের পায়রাবন্দ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন। স্মৃতি ধরে রাখতে তার জীবন, দর্শন ও সাহিত্যকর্ম নিয়ে গবেষণার জন্য ১৯৯৭ সালের ২৮ জুন ‘বেগম রোকেয়া স্মৃতি কেন্দ্রের’ ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ৫ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এই স্মৃতি কেন্দ্র ২০০১ সালের ১ জুলাই আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হয়। এরপর বিএনপি ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে স্মৃতি কেন্দ্রটির কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। পরে ২০০৮ সালের পর আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে বাংলা একাডেমিকে দেখভালের দায়িত্ব দিলেও স্থবির হয়ে আছে স্মৃতি কেন্দ্রের কার্যক্রম। তিনজন কর্মকর্তা এবং ছয়জন কর্মচারী থাকলেও দেখা মেলেনা অধিকাংশদের।

সরেজমিনে রোকেয়া স্মৃতি কেন্দ্র ঘুরে দেখা যায়, লাইব্রেরিতে সামান্য কিছু বই থাকলেও বাড়েনি সংগ্রহ। রয়েছে পর্যাপ্ত জনবলের অভাব। এদিকে দীর্ঘদিন ধরে সংস্কার না করায় ভবনের বিভিন্ন স্থানে ফাটল ধরেছে। নষ্ট হয়ে যাচ্ছে মূল্যবান অনেক জিনিসপত্র। অত্যাধুনিক অডিটোরিয়ামের আসবাবপত্র নষ্ট হয়ে গেছে। একই অবস্থা বেগম রোকেয়ার বাস্তুভিটাতেও। আজ অবধি সেখানে কোনো স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়নি। এতে আনাগোনা নেই দর্শনার্থীদের।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ২০০৯ সালের ৯ ডিসেম্বর রোকেয়া মেলার আলোচনাসভায় তার ভাতিজি রনজিনা সাবের দাবি তোলেন বেগম রোকেয়ার দেহাবশেষ কলকাতা থেকে ফিরিয়ে আনার। রংপুরের তত্কালীন জেলা প্রশাসক বি এম এনামুল হক দাবিটির প্রতি একাত্মতা ঘোষণা করে উদ্যোগ নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন।

২০১০ সালে একই স্থানে বি এম এনামুল হক বলেছিলেন, রোকেয়ার দেহাবশেষ পায়রাবন্দে আনার ব্যাপারে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন দপ্তরে আবেদন করা হয়েছে। ২০১১ সালের রোকেয়া দিবসের আগে তার দেহাবশেষ পায়রাবন্দে আসবে। এ ঘোষণায় সেদিন পায়রাবন্দবাসী আনন্দিত হয়েছিল। এরপর পেরিয়ে গেল এক দশক। এ ব্যাপারে আর কোনো উদ্যোগ নেয়নি জেলা প্রশাসন।

পায়রাবন্দ সরকারি বেগম রোকেয়া স্মৃতি মহাবিদ্যালয়ের উচ্চ মাধ্যমিক পড়ুয়া কয়েকজন শিক্ষার্থী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, শুধু ৯ ডিসেম্বর এলেই আমাদের মনে পড়ে রোকেয়া নামে এখানে কেউ একজন ছিলেন। কিন্তু দিবসটি পার হলেই আমরা তাকে আর স্মরণ করি না। আমাদের ইচ্ছা, আমরা রোকেয়ার কবরে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাব। কিন্তু ভারত থেকে তার দেহাবশেষ আনার কোনো উদ্যোগ নেই। দিন দিন রোকেয়ার ভিটেমাটি ও সম্পত্তিও বেহাত হয়ে যাচ্ছে। সব মিলিয়ে আগামী প্রজন্মের মধ্যে রোকেয়ার স্মৃতি বাঁচিয়ে রাখতে সরকারকে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।

পায়রাবন্দ বেগম রোকেয়া স্মৃতি সংসদের সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম দুলাল বলেন, বিবিসির জরিপে বিশ্বসেরা ২০ নারীর তালিকায় বেগম রোকেয়ার স্থান ৬ নম্বরে। অথচ তার দেহাবশেষ দেশে আনতে বছরের পর বছর গুনতে হচ্ছে। এটা দুঃখজনক। তৎকালীন জেলা প্রশাসকের প্রতিশ্রুতি এখনও চিঠি চালাচালিতেই সীমাবদ্ধ। বেগম রোকেয়াকে নিয়ে দেশে কাঠামোগত কিছু পরিবর্তন এসেছে। যেমন রোকেয়া স্মৃতিকেন্দ্র নির্মাণ, রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাসহ রোকেয়ার নামে সরকারি-বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও বিভিন্ন স্থাপনা রয়েছে। কিন্তু রোকেয়ার দর্শন ও চেতনাকে মনের মধ্যে লালন করা হচ্ছে না। স্মৃতিকেন্দ্রের পাঠাগারে রোকেয়া সম্পর্কিত দুটি বইপুস্তকও নেই। রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়েও রোকেয়াকে নিয়ে গবেষণা, পড়াশোনা হয় না। যার নামে বিশ্ববিদ্যালয় তার স্মৃতিস্মরণে ভাস্কর্যও নেই। রোকেয়ার বাস্তুভিটাকে প্রত্নসম্পদে পরিণত করতে কোনো উদ্যোগ নেই। আমার কাছে মনে হয়, এখন যা হচ্ছে, তা রোকেয়াকে ধারণ করে নয়, বরং এটা শুধুই আনুষ্ঠানিকতা। এ সময় নীতিনির্ধারকরা বিষয়টিকে গুরুত্ব দিচ্ছেন না বলে অভিযোগ করেন তিনি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. তুহিন ওয়াদুদ বলেন, ‘রোকেয়া কখনোই তার নামের আগে বেগম শব্দটি লিখেননি। কিন্তু সকলের কাছে বেগম শব্দটি প্রচলিত করে ফেলেছি। আমাদের এগিয়ে চলার পথে রোকেয়াচর্চা এ সময়ে খুবই প্রাসঙ্গিক। এ কারণে সকলের মাঝে বেগম শব্দটি যে ভুল ব্যবহার হচ্ছে, সেটি জানান দিয়ে সঠিকভাবে রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন নাম উপস্থাপিত হওয়া উচিত।’

রোকেয়া স্মৃতিকেন্দ্রের ইনচার্জ আবিদ করিম মুন্না বলেন, নতুন একটি প্রকল্পের মাধ্যমে স্মৃতিকেন্দ্রে বন্ধ থাকা বৃত্তিমূলক সেলাই প্রশিক্ষণ চালু করাসহ নারীদের আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টিতে নানা পদক্ষেপ নেওয়া হবে। সেই লক্ষ্যে প্রস্তাবনা তৈরি করা হচ্ছে। পাশাপাশি বেগম রোকেয়ার জীবন, সাহিত্য, কর্ম-দর্শন ব্যাপক প্রচার-প্রসারের লক্ষ্যে বাংলা একাডেমি থেকে আরো কিছু উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এই স্মৃতিকেন্দ্রটি আরো আধুনিক করা হবে। গবেষকদের জন্য বিশেষায়িত একটি গবেষণামূলক পাঠাগার ও ডরমিটরি করা হবে। এতে বিভিন্ন এলাকা থেকে আগত শিক্ষার্থী, দর্শনার্থী, গবেষক ও পর্যটকরা উপকৃত হবেন। আশা করছি, দ্রুত সময়ের মধ্যে রোকেয়া স্মৃতিকেন্দ্রটি আবারও প্রাণবন্ত হয়ে উঠবে।

বাংলা একাডেমির পরিচালক ডা. কে এম মোজাহেদুল ইসলাম বলেন, বর্তমানে প্রকল্পটি পরিকল্পনা কমিশনের সবুজ পাতায় তালিকাভুক্ত হয়েছে। ২০২৩ জুলাই থেকে ২০২৬ অর্থবছরের মধ্যে এটি বাস্তবায়নের কথা রয়েছে। স্থাপত্য অধিদপ্তর নকশা  প্রণয়ন করবে। রোকেয়া স্মৃতি সংসদের সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম দুলাল জানান, গত ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে স্মৃতিকেন্দ্রকে বিকেএমই গার্মেন্টস প্রশিক্ষণ কেন্দ্র করা হয়। সেনাসমর্থিত সরকার চলে যাওয়ার পর এটি দখলমুক্ত করে রোকেয়া চর্চার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করার দাবি থাকলেও বাস্তবে তেমন কিছু হয়নি।

মিঠাপুকুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শাহরিয়ার রহমান বলেন, জেলা প্রশাসনের সভায় বেগম রোকেয়া স্মৃতিকেন্দ্র চালুর পাশাপাশি সোদপুরে থাকা রোকেয়ার কবরটি আনার ব্যাপারে আলোচনা হয়েছে। বেগম রোকেয়া শুধু মিঠাপুকুর বা পায়রাবন্দের নন, তিনি সারা বাংলাদেশের। তিনি নারী জাগরণের অগ্রদূত ছিলেন। তার  বাস্তুভিটা এবং সম্পত্তি নিয়ে দুটি মামলা চলমান রয়েছে। আমরা সরকারের পক্ষ থেকে ইতিমধ্যে আদালতে একটা জবাব দিয়ে দিয়েছি। আমরা চেষ্টা করছি সেগুলো মনিটর করার। একই সঙ্গে ভারতের সোদপুরে থাকা বেগম রোকেয়ার কবরটি বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারেও কথাবার্তা হচ্ছে। এটি দুটি রাষ্ট্রের সরকার পক্ষের কূটনৈতিক বিষয়।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফাতেমাতুজ জোহরা বলেন, ‘রোকেয়া স্মৃতিকেন্দ্রের কার্যক্রম পুনরায় চালু করা ও বাস্তুভিটা সংরক্ষণের জন্য সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক মহোদয়কে অবগত করেছি। দ্রুতই এসবের বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন তিনি।

প্রসঙ্গত- বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন ১৮৮০ সালের ৯ ডিসেম্বর রংপুর জেলার মিঠাপুকুর উপজেলার পায়রাবন্দ গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। সে সময় মুসলিম সমাজে মেয়েদের লেখাপড়া শেখানোর কোনো চল ছিল না। তাই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকলেও পরিবারের সবার অগোচরে তার বড় ভাইয়ের কাছে উর্দু, বাংলা, আরবি ও ফারসি পড়তে এবং লিখতে শেখেন। তার জীবনে শিক্ষালাভ ও মূল্যবোধ গঠনে তার ভাই ও বড় বোন উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছিলেন। পরে বিহারের ভাগলপুরে সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে বিয়ে হয়। স্বামীর উত্সাহে ও নিজের আগ্রহে তিনি লেখাপড়ার প্রসার ঘটান। বেগম রোকেয়া ১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বর মারা যান। তিনি প্রাবন্ধিক, ঔপন্যাসিক, সাহিত্যিক ও সমাজ সংস্কারক হিসেবে পরিচিত। তার উল্লেখযোগ্য রচনা হলো ‘মতিচূর’, ‘সুলতানার স্বপ্ন’, ‘পদ্মরাগ’, ‘অবরোধ-বাসিনী’ ইত্যাদি।