অনলাইন ডেস্ক : অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য পশ্চিমা চাপের মধ্যেও ভারত ও চীনের সমর্থন নিশ্চিত করে টানা চতুর্থবারের মতো ক্ষমতায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ভারত যেকোনো মূল্যে শেখ হাসিনাকে সমর্থন দিয়ে যাওয়ার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তার পেছনে আছে আদানির সঙ্গে একটি ‘বিতর্কিত ব্যবসায়িক চুক্তি’।
বাংলাদেশের মধ্যে ব্যাপক সমালোচনা সত্ত্বেও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির খুব ঘনিষ্ঠ বলে বিবেচিত আদানি ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর সঙ্গে বিদ্যুৎ ক্রয়ের চুক্তি সম্পন্ন করতে পিছপা হননি শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনাকে নিঃশর্ত সমর্থন দিয়ে যাওয়ার বিষয়ে মোদিকে সতর্ক করেছিলেন ভারতীয় কর্মকর্তারা। কিন্তু অনেকেই মনে করেন যে, ওই চুক্তির কারণে সে সতর্কতা কানে তোলেননি মোদি।
বিরোধী দলহীন নির্বাচনে অংশ নেয়া প্রার্থীদের মান ও জনপ্রিয়তার কোনো ভূমিকা ছিল না। নির্বাচনে সমর্থনের জন্য বিশাল অঙ্কের অর্থের একটি অংশ দিল্লিতে ক্ষমতার শীর্ষে থাকাদের কাছে পৌঁছে গেছে বলেও গুঞ্জন রয়েছে।
গৌতম আদানির প্রতিষ্ঠিত ‘আদানি পাওয়ার লিমিটেড’ ভারতের বৃহত্তম বেসরকারী বিদ্যুৎ কোম্পানি। ভারতের ঝাড়খণ্ড রাজ্যে ১.৭ বিলিয়ন ডলার ব্যায়ে নির্মিত গোড্ডা প্ল্যান্ট নিয়ে বাংলাদেশে সমালোচনা হয়েছে। কারণ এই বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি (পিপিএ) থেকে ব্যাপক লাভবান হয়েছে ভারতীয় এই কোম্পানি। ভারতীয় সীমান্ত পর্যন্ত প্রায় ১০৬ কিলোমিটার ডেডিকেটেড ট্রান্সমিশন লাইনের মাধ্যমে গোড্ডা থেকে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ আসছে।
গত বছরের ৪ এপ্রিল এর বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু হয়। ৩০শে জুন থেকে পরবর্তী তিন মাসে এই কেন্দ্র থেকে ১৫৯.৮ কোটি ইউনিট বিদ্যুৎ (কিলোওয়াট-ঘণ্টা) উৎপাদন করা হয়েছে। ইউনিট প্রতি খরচ ছিল ১৪.০২ টাকা, যেখানে ২০১২ সালে ভারতের পাবলিক সেক্টর ‘বেহেমথ ন্যাশনাল থার্মাল পাওয়ার কর্পোরেশন’ (এনটিপিসি) থেকে ৩০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত প্রতি ইউনিট ৩.২৪ টাকায় কিনতে রাজি হয়েছিল বাংলাদেশ।
আদানির সঙ্গে চুক্তির অধীনে, বাংলাদেশ তুলনামূলক নিম্নমানের কয়লার জন্য তার অন্যান্য কয়লা-ভিত্তিক বিদ্যুতের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি দাম দেবে। সেই কয়লা অস্ট্রেলিয়ার আদানি-মালিকানাধীন খনি থেকে ভারতের একটি আদানি-মালিকানাধীন বন্দরে সরবরাহ করা হবে যেখান থেকে এটি গোড্ডা প্ল্যান্টে পাঠানো হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, আদানি পাওয়ার লিমিটেডের গোড্ডা প্ল্যান্টকে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল (এসইজেড) ঘোষণা করার সময় যে কর অব্যাহতি দেয়া হয়েছিল, বাংলাদেশ সেই সুবিধা পাচ্ছে না। একটি বেসরকারি কয়লা প্ল্যান্টের জন্য একাধিক ট্যাক্স সুবিধা দেওয়ার কারণে ভারতে মোদি সরকারের বিরুদ্ধে প্রশ্ন তুলেছেন সমালোচকরা। নিজেদের পরিবেশ ও জনগণকে হুমকিতে ফেলে অন্য একটি দেশের জন্য বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করার পেছনে তারা আদানি গ্রুপকে অতিরিক্ত সুবিধা পাইয়ে দেয়ার বিষয়টি উল্লেখ করেছেন তারা।
২০২২ সালে শ্রীলঙ্কার একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা লঙ্কান সংসদীয় প্যানেলের সামনে দাবি করেছিলেন যে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া রাজাপাকসেকে আদানি গ্রুপকে একটি বিদ্যুৎ প্রকল্প দেয়ার জন্য চাপ দিয়েছিলেন। কিন্তু বিতর্ক ছড়িয়ে পড়ায় একদিন পরে ওই বিবৃতিটি প্রত্যাহার করেন তিনি। দ্বীপরাষ্ট্রটির উত্তর মান্নার জেলায় অবস্থিত ৫০০ মেগাওয়াটের ওই পুনর্নবীকরণযোগ্য বিদ্যুৎ প্রকল্প। শ্রীলঙ্কার সিলন ইলেকট্রিসিটি বোর্ডের (সিইবি) চেয়ারম্যান এমএমসি ফার্দিনান্দো কলম্বোতে একটি সংসদীয় প্যানেলের সামনে উপস্থিত হয়ে দাবি করেছিলেন যে, প্রেসিডেন্ট রাজাপাকসের সাথে তার কথোপকথনের সময় তাকে বলা হয়েছিল যে মোদি প্রকল্পটি আদানিকে দিতে চান।
বাংলাদেশের বিদ্যুৎ নিয়ন্ত্রক সংস্থার সাবেক মহাপরিচালক বি ডি রহমতুল্লাহ আল-জাজিরাকে বলেছিলেন যে, এই চুক্তিতে শুধুমাত্র আদানিরই লাভ হবে। দুর্ভাগ্যবশত এটাকে ঘিরে ক্রমবর্ধমান অসন্তোষ সত্ত্বেও আমাদের সরকারের এই বিদ্যুৎ ক্রয় ব্যবস্থা সংশোধন করার বা এর থেকে বেরিয়ে আসার কোনো ইচ্ছা নেই। যদিও আদানি ও বাংলাদেশ সরকারের মধ্যেকার এই চুক্তিটি প্রায় ছয় বছর পুরানো, তারপরেও এ নিয়ে খুব একটা ‘সমালোচনার ঝড়’ দেখা যায়নি- অন্তত রাজনৈতিকভাবে। কারণ এই চুক্তির বিস্তারিত কখনও প্রকাশই করা হয়নি। চুক্তিটি বাংলাদেশের একটি বিতর্কিত বিশেষ আইনের অধীনে করা হয়েছিল, যা সরকারকে অযাচিত পিপিএ বা বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তির সুযোগ দেয়। বিশ্লেষকরা বলছেন যে, বাংলাদেশ বিদ্যুৎ চুক্তির পথে গিয়েছিলো কারণ এতে তৎকালীন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ দলের বড় রাজনৈতিক প্রভাব ছিল।
ব্রাসেলসের ভ্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের গবেষণা ফেলো সাইমুম পারভেজ আল জাজিরাকে বলেন, আওয়ামী লীগের কাছে এটা অজানা ছিল না যে আদানি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত এবং একটি ব্যবসায়িক চুক্তি শেষ পর্যন্ত মোদির কাছ থেকে আওয়ামী লীগ সরকারের জন্য রাজনৈতিক সুবিধা নিয়ে আসবে। অত্যন্ত বিতর্কিত নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় থাকতে রাজনৈতিক বৈধতা নিশ্চিত করার জন্য প্রধান আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে ভারতের কাছ থেকে অনুগ্রহের প্রয়োজন ছিল আওয়ামী লীগের। আঞ্চলিক পরাশক্তি ভারতের কাছ থেকে তাদের সব ধরনের সমর্থনের দরকার ছিল।
পারভেজের মতে, আদানির সাথে চুক্তিটি দীর্ঘ সময়ের জন্য খুব বেশি ক্ষোভের সৃষ্টি করেনি কারণ আওয়ামী লীগ সরকার বিরোধী দলগুলির যে কোনও ধরনের সমালোচনা বন্ধ করার পাশাপাশি কঠোর আইন প্রণয়ন করে গণমাধ্যমকে স্তব্ধ করে দিয়েছে। কিন্তু ২০২২ সালের মাঝামাঝি থেকে এই অবস্থা বদলাতে থাকে।
পারভেজ বলেন, বাংলাদেশ যখন মুদ্রাস্ফীতি, মূল্যবৃদ্ধি, বৈদেশিক রিজার্ভ হ্রাস এবং একাধিক ব্যাংক থেকে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার আত্মসাতের ধাক্কা অনুভব করতে শুরু করে তখন জনসাধারণের মধ্যে অসন্তোষ বাড়তে থাকে। দীর্ঘদিন পর বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো ২০২২ সালের শেষদিকে বেশ কয়েকটি বড় ধরনের বিক্ষোভ আয়োজন করেছিল। ২০২৩ এর শুরুতে সামনে আসে হিন্ডেনবার্গ রিপোর্ট, যা বিক্ষোভের মধ্যে আরো ইন্ধন জুগিয়েছিল বলে মনে করেন পারভেজ।
আদানি মাত্র কয়েক মাস আগেও বিশ্বের দ্বিতীয় ধনী ব্যক্তি ছিলেন। হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ নামে মার্কিনভিত্তিক সংস্থার একটি বিস্ফোরক রিপোর্ট তাকে স্টক মার্কেট ম্যানিপুলেশনের দায়ে অভিযুক্ত করেছিল। ওই জালিয়াতির অভিযোগের কয়েক সপ্তাহের মধ্যে আদানি প্রায় ১০০ বিলিয়ন ডলারের বেশি সম্পদ হারান। ঝাড়খন্ডে আদানি-নির্মিত গোড্ডা আল্ট্রা সুপার-ক্রিটিকাল থার্মাল পাওয়ার প্ল্যান্ট বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু করার পরে এই ধরনের বিতর্কে জড়িয়ে থাকা সত্ত্বেও গত জুলাই মাসে গৌতম আদানির সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
আদানি একটি সোশ্যাল মিডিয়া পোস্টে বলেন- ১৬০০ মেগাওয়াট আল্ট্রা সুপার-ক্রিটিকাল গোড্ডা পাওয়ার প্ল্যান্টের সম্পূর্ণ লোড শুরু এবং হস্তান্তরের বিষয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করতে পেরে আমি সম্মানিত। আমি ভারত ও বাংলাদেশের নিবেদিতপ্রাণ টিমগুলিকে অভিবাদন জানাই, যারা কোভিড-এর মধ্যেও সাহসী পদক্ষেপ নিয়ে সাড়ে তিন বছরের রেকর্ড সময়ে প্ল্যান্টটি চালু করেছে।
আদানি গ্রুপের প্রেস নোটে জানানো হয়েছে যে, গোড্ডা প্ল্যান্টের ৮০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার প্রথম ইউনিটটি বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু হয়েছে। আদানি গ্রুপ এক বিবৃতিতে বলে, গোড্ডা ইউএসসিটিপিপির কমিশনিং আদানি গ্রুপ এবং বাংলাদেশ পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ডের (বিপিডিবি) জন্য এটি একটি উল্লেখযোগ্য মাইলফলক। দুই দেশের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা এবং শক্তিশালী অর্থনৈতিক সম্পর্কের জন্য এটি গুরুত্বপূর্ণ। আদানি পাওয়ার প্রতিযোগিতামূলক শুল্কে নিরবচ্ছিন্ন এবং নির্ভরযোগ্য বিদ্যুৎ সরবরাহের মাধ্যমে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও সমৃদ্ধির অংশীদার হয়েছে।
এখন জানা যাচ্ছে যে, আদানি পাওয়ার থেকে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ ক্রয় ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে আদানির ব্যাপক মুনাফায় অবদান রেখেছিল। ২০১৭ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশ ‘আদানি পাওয়ার ঝাড়খন্ডের’ সাথে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে, যেটির প্রধান কার্যালয় আহমেদাবাদে অবস্থিত। বিশ্লেষকদের মতে, বিদ্যুৎ আমদানি করতে এই চুক্তিটি ভারতীয় কোম্পানিটির জন্য আরও লাভ নিশ্চিত করবে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের এপ্রিল-ডিসেম্বর মাসের মধ্যে আদানি পাওয়ারের রাজস্ব ৪০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ৩৭ হাজার ১৭৩ কোটি রুপি (৪৮ হাজার ৯১১ কোটি টাকা) হয়েছে। এতে ঝাড়খণ্ড ইউনিট ৫ হাজার ৩২৬ কোটি টাকা বা মোট ১৪.৩ শতাংশ অবদান রেখেছে।
অক্টোবর-ডিসেম্বরের শেষদিকে আদানি পাওয়ারের রাজস্ব ৭২ শতাংশ বেড়ে ১৩ হাজার ৪০৫ কোটি রুপি হয়েছে। কোম্পানিটির প্রকাশ করা পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এর মুনাফা এই সময়ের মধ্যে ৯ কোটি টাকা থেকে ২ হাজার ৭৩৮ কোটি রুপিতে পৌঁছেছে। আদানি সংস্থা বিশ্লেষকদের জানিয়েছে, গোড্ডা প্ল্যান্ট চালু হওয়ার পর এর উচ্চ পরিচালন ক্ষমতা, চাহিদা বৃদ্ধি এবং আমদানিকৃত জ্বালানির দাম কমার কারণে কোম্পানির রাজস্ব বৃদ্ধি পেয়েছে। গোড্ডা পাওয়ার প্ল্যান্টের অন্তর্ভুক্তি তৃতীয় ত্রৈমাসিকে আদানি পাওয়ারের রাজস্বে ১ হাজার ৮২৪ কোটি রুপি যোগ করেছে। বহুজাতিক কোম্পানিটির ইবিআইটিডিএ (সুদ, কর, অবচয়, এবং পরিশোধের আগে আয়) ত্রৈমাসিকে বছরে ২৪২ শতাংশ বেড়ে ৫ হাজার ৫৯ কোটি রুপি হয়েছে। ইবিআইটিডিএ থেকে জানা যায় যে, একটি কোম্পানি কতটা ভালোভাবে তার দৈনন্দিন কার্যক্রম পরিচালনা করছে। কোম্পানিটি বলেছে যে, কম জ্বালানি খরচ এবং শক্তিশালী বাণিজ্যিক মূল্যের কারণেই তাদের ইবিআইটিডিএ বেড়েছে। জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিস্তৃত দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে আদানি পাওয়ারের আয় ৬১ শতাংশ বেড়ে ১২ হাজার ১৫৫ কোটি রুপি হয়েছে। এরমধ্যে গোড্ডা প্ল্যান্টের অবদান ছিল ২ হাজার ৩৪ কোটি রুপি। প্রথম ত্রৈমাসিকে গোড্ডা প্ল্যান্ট রাজস্বে ১ হাজার ৪৬৮ কোটি রুপি যোগ করেছে।