মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার রাজকান্দি সংরক্ষিত বনাঞ্চলের গভীরে হাম হাম জলপ্রপাতের অবস্থান। ২০১০ সালের শেষে পর্যটন গাইড শ্যামল দেববর্মাকে সঙ্গে নিয়ে একদল পর্যটক এই অনিন্দ্য সুন্দর জলপ্রপাতটি আবিষ্কার করেন।
স্থানীয়দের কাছে, এই ঝরনা চিতা ঝরনা হিসেবে পরিচিত। তাদের মতে, এই জঙ্গলে আগে চিতা বাঘ পাওয়া যেত। সেই হামহাম জলপ্রপাত ভ্রমণে গিয়েছে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল শিক্ষার্থীরা।
সেমিস্টার ফাইনালের শেষ। টানা পরীক্ষা শেষে বিধস্ত মন। মনকে চাঙ্গা করতে তারা ট্রেকিং করতে যাবে বলে ঠিক করে। কোথায় যাবে? তুমুল এক যুক্তিতর্ক শেষে ঠিক হলো ঘুরতে যাওয়া হবে হামহাম জলপ্রপাতে। সেই ভ্রমণ গল্প নিয়েই লিখেছেন রায়হান আবিদ-
তখন রাত ১০টা। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হামহামের উদ্দেশ্যে রওনা দেয় আরমান, বিপা, অবনী, প্রিতম, সাদিক, বাকিয়া, অমি, লিজা ও অর্পা। ঘুরতে যাওয়ার আনন্দে সবার চোখ থেকে ঘুম পালিয়ে গেল।
ভোর ৪টা বাজে তারা শ্রীমঙ্গল পৌঁছায়। চোখে তখন আধো অধো ঘুম। আগে থেকেই বুকিং দিয়ে রাখা চাঁদের গাড়ি নিয়ে রওনা হয় হামহামের উদ্দেশ্যে। শ্রীমঙ্গল শহর থেকে মোটামুটি ঘণ্টার রাস্তা। প্রায় ১৪০ ফুট উঁচু এই ঝরনার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখার জন্যে সমগ্র বাংলাদেশ থেকে মানুষ ছুটে আসেন।
চাঁদের গাড়ি চলছে শ্রীমঙ্গল দিয়ে। চায়ের শহর শ্রীমঙ্গল। যতদূর পর্যন্ত দেখা যায় শুধু চা বাগান আর চা বাগান। এ যেন কোনো রূপকথার রাজ্য। সেই রাজ্যের মধ্য দিয়ে পাহাড়ি আঁকাবাঁকা রাস্তা দিয়ে চাঁদের গাড়ি যাচ্ছে।
চারপাশের এমন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য চাঁদের গাড়ির মধ্যে বসে থেকে উপভোগ করা অসম্ভব। তাই সবাই উঠে গেল চাঁদের গাড়ির ছাদে। বাতাসের ঝটকা যেন উড়িয়ে নেওয়ার জোগাড়। আর পাহাড়ি একেকটি বাঁকে হৃদপিণ্ড যেন হঠাৎ হঠাৎ থমকে যাচ্ছিলো।
আগেরদিন বৃষ্টি হওয়ায় যাওয়ার রাস্তা বেশ পিচ্ছিল ছিলো। এবার চাঁদের গাড়ি থেকে নেমে হাম হাম জলপ্রপাতে পর্যন্ত পৌঁছাতে তাদের মোটামুটি চার কিলোমিটার পাহাড়ি পথ ট্র্যাকিং করতে হয়েছে। মাটিতে পা চেপে ধরে ধরে এগিয়ে যেতে হচ্ছিলো তাদের। মনে তাদের সংশয় ছিলো বৃষ্টি নামলেই এরকম জায়গাগুলোতে পাহাড়ি ঢল নামে।
হামহাম দেখতে এসে অনেক পর্যটক প্রাণ হারিয়েছেন। চারদিকে পাহাড় আর পাহাড়। ঝপঝপ শব্দে ঝরনা দিয়ে সমান ধারায় পানি আছড়ে পড়ছে। তারা সবাই সাপোর্ট হিসেবে একটি করে বাঁশ নিলো ও সবাই পায়ে এংলেট পড়ে পাহাড়ী পিচ্ছিল পথের দিকে চলতে থাকে।
হামহামে ট্রেকিং করা খুব কঠিন। বারবার পাহাড়ে ওঠানামা, ছোট ছোট বাঁক, পাহাড়ি পথ পাড়ি দিয়ে আবার কখনো পিচ্ছিল পাথর ডিঙিয়ে তারা পৌঁছায় সেই কাঙ্ক্ষিত জলপ্রপাতের কাছাকাছি। দূর থেকেই শোনা যায়, পাথরে আছড়ে পড়া ঝরনার ধ্বনি-প্রতিধ্বনি।
এর মধ্যে হঠাৎ এক অঘটন ঘটে। অবনীর পায়ে জোঁক কামড়ে ধরেছে। তাড়াতাড়ি করে আরমান হিরোর মতো দৌড়ে এসে একটানেই ছাড়িয়ে নিয়ে জোঁকটা ছুড়ে ফেলে দিল। অবশেষে আবারো হাঁটতে হাঁটতে তারা চলে আসে র একদম মুখোমুখি।
অর্পা বলে, এই সৌন্দর্য ভাষায় প্রকাশ করার মতো না। হতবাক হয়ে কয়েক মিনিট আমরা তাকিয়ে ছিলাম ঝরনার অকৃত্রিম সৌন্দর্যের দিকে। প্রকৃতি আসলে কতটা ভয়ংকর সুন্দর হতে পারে তা এর কাছাকাছি গেলেই বোঝা যায়। প্রায় দেড় ঘণ্টার কষ্টকর ট্র্যাকিংয়ের ক্লান্তি এক নিমিষেই উধাও হয়ে গেলো আমাদের। সবাই সেখানে ঝরনার পানিতে নামি।
ভ্রমণপিপাসু আরমান জানান, ঝরন দেখার স্বপ্ন সবারই থাকে। আর এটা দেখার উপযুক্ত সময় হলো বর্ষাকাল। বর্ষাকালে ঝরনার বুনো সৌন্দর্য যেমন উপভোগ করা যায় তেমনই ঝরনার পানির শব্দে খুঁজে বের করার আনন্দ ও উত্তেজনা কাছে যেন নিবার্ক করার মতো।
এ জন্যই শত শত ভ্রমণপিপাসু মানুষ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথে ট্র্যাকিং করে ঝরনার কাছ পর্যন্ত যায়। শুধু এর অপরূপ সৌন্দর্য কাছ থেকে উপভোগ করার জন্য। শ্রীমঙ্গল বলতে গেলে চিত্রশিল্পীর তুলিতে আঁকা কোনো একটি শহর।
দু’চোখ ভরে যায়। আর হামহাম জলপ্রপাত হলো কোনো রূপকথা। যার প্রতি বাঁকে বাঁকে অ্যাডভেঞ্চার। যতদিন বেঁচে আছি, জগতের এই সৌন্দর্যগুলোই দেখে যেতে চাই।
এবার ফেরার পালা। তবে ফেরার পথে নামলো বৃষ্টি। বৃষ্টিতে পাহাড়ি পথ পিচ্ছিল হয়ে যায়। ধুপধাপ পিছলে মাটিতে পড়ে যাচ্ছিলো অনেকে। তবে বৃষ্টিতে ভেজা রূপকথা পাহাড়ি দৃশ্যগুলো উপভোগ করতে ভুলেনি তারা।