ঢাকা , রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

জলদস্যুদের হাতে ৩১ দিন জিম্মি থাকার পর মুক্তি পেয়েছেন ২৩ জন নাবিক : জিম্মিদশার লোমহর্ষক বর্ণনা দিলেন জাহাজের ক্যাপ্টেন

  • ডেস্ক :
  • আপডেট সময় ০৯:০০ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৭ এপ্রিল ২০২৪
  • 182
অনলাইন ডেস্ক :  ভারত মহাসাগরে সোমালিয়ার জলদস্যুদের হাতে ৩১ দিন জিম্মি থাকার পর মুক্তি পেয়েছেন বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আব্দুল্লাহর ২৩ জন নাবিক। গেল রবিবার রাতে চট্টগ্রামের কেএসআরএম গ্রুপের এই জিম্মি জাহাজ থেকে নেমে যায় সোমালিয়ার জলদস্যুরা। কীভাবে কাটল ৩১ দিন। সেই ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন জাহাজের মাস্টার ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ আবদুর রশিদ। গত মঙ্গলবার (১৬ এপ্রিল) হোয়াটসঅ্যাপে গণমাধ্যমের কাছে জিম্মিদশার বর্ণনা দেন তিনি। ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ আবদুর রশিদ জানান, মার্চের ১২ তারিখ সকালে ২৩ বাংলাদেশি নাবিকসহ এমভি আবদুল্লাহ নীল সাগরে ছুটে চলছিল। কেবিনে অফিসের কাজ সেরে সকাল সাড়ে ৯টায় জাহাজ পরিচালনা কক্ষ- ব্রিজ থেকে মাস্টারের চেয়ারে গিয়ে বসি। বসেই জাহাজের দায়িত্বে থাকা তৃতীয় কর্মকর্তাকে বলি, সব ঠিকঠাক আছে তো? মোজাম্বিকের মাপুতো বন্দর থেকে কয়লা বোঝাই করে সোমালিয়ার উপকূল থেকে ৬০০ নটিক্যাল মাইল দূরে ভারত মহাসাগর হয়ে যাওয়ার পথে তৃতীয় কর্মকর্তা জানালেন, স্যার, জাহাজের ডান পাশে অনেক দূরে একটি ফিশিং বোট দেখা যাচ্ছে।
দৃশ্যমান সেই ফিশিং বোট থেকে ব্যবধান বাড়িয়ে দিতে জাহাজটি বাঁয়ে ঘুরিয়ে দিয়ে নৌযানটি আমরা পর্যবেক্ষণ শুরু করি। হঠাৎ করে দেখি, নৌযানটি থেকে একটি স্পিডবোট সাগরে ভাসানো হয়েছে। তখনই আমরা নিশ্চিত হয়ে যাই, জলদস্যুরা আসছে। এমভি আবদুল্লাহ জাহাজে কয়লা বোঝাই থাকায় আমাদের গতি ছিল কম। ঘণ্টায় সাড়ে ১০ নটিক্যাল মাইল।
স্পিডবোটটি কাছাকাছি চলে এলে ঢেউ সৃষ্টি করে এবং উচ্চচাপে পানি ছিটিয়ে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করি। আবার ডানে-বাঁয়ে জাহাজ ঘুরিয়ে স্পিডবোটটির গতি কমানোর চেষ্টা শুরু করি। এ সময় যুক্তরাজ্যের মেরিটাইম ট্রেড অপারেশনে যোগাযোগ করি। সেখানে কেউ ফোন ধরেননি। সে সময় যোগাযোগ করে কাছাকাছি কোনো যুদ্ধজাহাজও পাইনি।
জলদস্যুরা উঠে যাবে বুঝতে পেরে আমরা জাহাজের সুরক্ষিত কক্ষ- সিটাডেলে আশ্রয় নেওয়ার শেষ চেষ্টা করি। নাবিকের সিটাডেলে যাওয়ার নির্দেশ দিই। তবে চারজন জলদস্যু অস্বাভাবিক গতিতে ব্রিজে ওঠে পড়তে সক্ষম হয়। তারা প্রথমে দ্বিতীয় কর্মকর্তার মাথায় অস্ত্র ঠেকিয়ে ‘মাস্টার মাস্টার’ বলে চিৎকার করে। আমাকে খুঁজতে থাকে। দ্বিতীয় কর্মকর্তা ভয় পেয়ে যান। আমি দ্রুত সেখানে চলে এসে হাত তুলি। তখনই জলদস্যুরা ‘অল ক্রু’ বলে চিৎকার করতে থাকে।
এরপরই আমি সব নাবিককে ব্রিজে চলে আসার নির্দেশ দিই। নাবিকরা শুরুতে বেশ ভয় পেয়ে যান। জলদস্যুরা জাহাজের ইঞ্জিন বন্ধ করার কথা বলে। ইঞ্জিন বন্ধ করার পর মাছ ধরার নৌযানটি আমাদের জাহাজের সঙ্গে বাঁধা হয়। ওই নৌযানে একজন পাকিস্তানি এবং বাকিরা ছিলেন ইরানের জেলে। নৌযানে থাকা সব জলদস্যু জাহাজে ওঠে। মোট ১২ জন সশস্ত্র জলদস্যু আমাদের জাহাজের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। আমাদের কাছ থেকে মুঠোফোন কেড়ে নিলেও ল্যাপটপ ও কয়েকটি মুঠোফোন আমরা লুকিয়ে রেখেছিলাম। এ সময় জলদস্যুরা আনন্দ উল্লাস করতে থাকে। ফাঁকা গুলি ছোড়ে।
ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ আবদুর রশিদ জানান, নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার পর থেকে জলদস্যুদের নির্দেশনায় চলতে থাকে জাহাজটি। এবার তাদের নির্দেশে আমরা এমভি আবদুল্লাহর ইঞ্জিন চালু করি। সোমালিয়ার উপকূলের দিকে যাওয়ার নির্দেশনা দেয় জলদস্যুরা। সে সময় একজন জলদস্যু একটি নম্বরে যোগাযোগ করতে বলে। কল দেওয়ার পর ‘আহমেদ’ পরিচয় দিয়ে ফোনের অপর প্রান্ত থেকে বলা হয়, ‘হাউ আর ইউ ক্যাপ্টেন এভরিথিং ইজ ওকে’ এরপরই জাহাজটি কীভাবে কোথায় নিতে হবে, তার পথনির্দেশনা দিয়ে দেয় জলদস্যু নেতা। সে অনুযায়ী, জাহাজ চলতে থাকে।
রোজার দ্বিতীয় দিনে ইফতারের আগে ইউরোপীয় ইউনিয়নের অপারেশন আটলান্টার একটি যুদ্ধজাহাজ এমভি আবদুল্লাহর পিছু নেয়। যুদ্ধজাহাজ থেকে এমভি আবদুল্লাহ জাহাজের ভিএইচএফে জলদস্যুদের নির্দেশনা দেওয়া হয়, ‘তোমরা জাহাজ ছেড়ে যাও। না হলে অভিযান চালানো হবে।’ নির্দেশনায় কোনো কাজ হয়নি। যুদ্ধজাহাজ থেকে একটি হেলিকপ্টার আকাশে ওড়ানো হয়। একপর্যায়ে এমভি আবদুল্লাহর চারপাশে পানিতে হেলিকপ্টার থেকে গুলিবর্ষণ করা হয়। তাতেও কোনো কাজ হয়নি।
যুদ্ধজাহাজ যাতে দ্রুত চলে যায়, তা বলার জন্য আমাকে জলদস্যুরা ভয় দেখায় অস্ত্র তাক করে। আমি ভিএইচএফে জানাই, ‘আমরা অস্ত্রের মুখে আছি। তোমরা দূরে চলে যাও। প্রায় আধা ঘণ্টা পর যুদ্ধজাহাজ দূরে চলে যায়। যুদ্ধজাহাজ পিছু নেওয়ায় দুই দফা নোঙর তুলে তৃতীয় দফায় সোমালিয়া উপকূলের জেফলের দিকে এমভি আবদুল্লাহকে নিয়ে যায় জলদস্যুরা।
তিনি বলেন, মোট ৩৫ জন জলদস্যু জাহাজে ওঠে। যুদ্ধজাহাজ পিছু নেওয়ায় জলদস্যুরা জাহাজে ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আসে। রকেট লঞ্চার, মেশিনগান, এম-সিক্সটিনসহ নানা রকমের অস্ত্র। মনে হয়েছে, যেন যুদ্ধক্ষেত্রে আছি। জলদস্যুদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার না করে উপায় নেই। ভালো ব্যবহার করায় তারা আমাদের কেবিনে থাকার সুযোগ দেয়। কবে মুক্তি পাবো, মনে মনে শুধু সেই ভাবনা ভিড় করে।
আমরা ১৬ জানুয়ারি জাহাজ নিয়ে চট্টগ্রাম থেকে যাত্রা শুরু করেছিলাম। পথে শ্রীলঙ্কার হাম্বানটোটা বন্দর হয়ে মোজাম্বিকের মাপুতো থেকে কয়লা বোঝাই করেছিলাম। চট্টগ্রাম ছেড়ে যাওয়ার আগে প্রায় ১৪ লাখ টাকার বাজারসদাইয়ের ব্যবস্থা করে দিয়েছিল জাহাজটির মালিকপক্ষ এসআর শিপিং (কেএসআরএম গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান)। জাহাজে তিন মাসের খাবার ছিল। জলদস্যুরা জাহাজে দুম্বা নিয়ে আসত। গরম পানিতে সেদ্ধ করে লবণ ও কিছু মসলা মিশিয়ে তারা তা খেত। এগুলো আমাদের জন্য খাওয়ার অযোগ্য ছিল। একপর্যায়ে তারা নিজেদের রান্না করার জন্য লোক নিয়ে আসে জাহাজে। আমরা ইফতারের সময় লেবুসহ নানা ধরনের শরবত পান করতাম। সেহরিতে ভাতের পাশাপাশি দুধ থাকত। জাহাজে পানি শেষ হয়ে গেলে বিপদে পড়ব- এমন আশঙ্কায় শুধু খাবার পানি সরবরাহ ঠিক রাখতাম আমরা।
এদিকে, গণমাধ্যমসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছবি দেখে জলদস্যুরা প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হয়। তাদের সন্দেহ হয়, নিশ্চয়ই নাবিকদের কাছে মুঠোফোন আছে। আহমেদ বলতে থাকে, ‘তোরা এই ছবি পাঠিয়েছিস’ পরে আমরা বলি, ‘মুঠোফোন নয়, ল্যাপটপ দিয়ে ছবি পাঠানো হয়েছে।’ পরে ল্যাপটপ কেড়ে নেয় জলদস্যুরা।
জলদস্যুদের ভিডিও করার বর্ণনা দিয়ে মোহাম্মদ আবদুর রশিদ বলেন, মুক্তি পাওয়ার দুই দিন আগে হঠাৎ আহমেদ এসে সবাইকে ডেকে নিয়ে দাঁড়াতে বলে। সে আমাদের ভিডিও করতে শুরু করে। তার কথা অনুযায়ী, আমি নাবিকদের নাম জিজ্ঞাসা করে পরিচয় করে দিই। শুনেছি, এই ভিডিও তারা কেএসআরএম গ্রুপের কাছে পাঠিয়েছে। আমরা যে সুস্থ আছি, তা দেখতে চেয়েছে কেএসআরএম গ্রুপ। আমাদের মনে তখন আশার সঞ্চার হয়। এর দুদিন পর আবার সব নাবিককে ডেকে এক লাইনে দাঁড় করিয়ে রাখে জলদস্যুরা। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর দেখি, ছোট আকারের একটি উড়োজাহাজ আসছে। অদূরে দুটি যুদ্ধজাহাজ। আমরা ভয় পেয়ে যাই। কারণ, তখন এমভি আবদুল্লাহ জাহাজে ৬৫ জন জলদস্যু। তাদের কাছে ভারী অস্ত্রশস্ত্র আছে।
জলদস্যুদের নির্দেশে এমভি আবদুল্লাহর নোঙর তুলে পেছনের দিকে সরিয়ে নিতে থাকি। জাহাজ পেছনের দিকে সরিয়ে নেওয়া হতে থাকে। একপর্যায়ে দেখতে পাই, রাতে তীর থেকে জাহাজের দিকে আলো ফেলে ইশারা দেওয়া হচ্ছে। জলদস্যুদের নির্দেশে জাহাজের ইঞ্জিন বন্ধ করা হয়। এ সময় পাঁচটি স্পিডবোটে করে সব জলদস্যু অস্ত্রসহ জাহাজ থেকে নেমে যায়। তখন সোমালিয়ার সময় ১৩ এপ্রিল দিবাগত রাত ১২টা ৮ মিনিট অর্থাৎ ১৪ এপ্রিল প্রথম প্রহর।
জলদস্যুরা নেমে যাওয়ার পর জাহাজটি ঘুরিয়ে সোমালিয়া উপকূল ত্যাগ করতে শুরু করি। সবাই পরিবার ও স্বজনদের কাছে মুক্তির বার্তা দিতে ধাকে। এ সময় সবার মধ্যে জীবন ফিরে পাওয়ার আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। রাতের বেলায় জাহাজ চলছে। দুই পাশে তখন ইউরোপীয় ইউনিয়নের নৌবাহিনীর দুটি যুদ্ধজাহাজ। ইউরোপীয় ইউনিয়নের নৌবাহিনীতে থাকা চিকিৎসকেরা আমাদের সব নাবিকের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করেন। স্প্যানিশ নৌবাহিনীর একজন নারী চিকিৎসক আমাকে বলেন, ‘সব নাবিক সুস্থ আছেন।’ তিনি বলেন, আমরা জলদস্যুদের হাত থেকে এত দ্রুত মুক্তি পাব তা কল্পনাও করিনি। সোমালিয়ার উপকূল থেকে জিম্মি জাহাজের এক মাসের মধ্যে মুক্তি পাওয়ার ঘটনার নজির খুব একটা নেই। জিম্মিদশার পর থেকে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর সদর দপ্তর সার্বক্ষণিক আমাদের জাহাজের অবস্থানের ওপর নজর রেখেছে। তারা ইউরোপীয় ইউনিয়নের নৌবাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে সব সময় আমাদের পাশেই ছিল। এমভি আব্দুল্লাহর বর্তমান অবস্থা প্রসঙ্গে তিনি জানান, গতকাল মঙ্গলবারও জাহাজটি ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে ছিল। তবে বুধবার সেই ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা অতিক্রম করবে। সে ক্ষেত্রে ২২ এপ্রিল দুপুরের মধ্যে জাহাজটি সংযুক্ত আরব আমিরাতের আল হামরিয়া বন্দরে পৌঁছাতে পারে।
এই মুক্তির জন্য আমরা প্রধানমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞ জানাই। তারা সহযোগিতা না করলে মুক্তি সম্ভব হতো না বলে মনে করেন ক্যাপ্টেন আবদুর রশিদ।
ট্যাগস
জনপ্রিয় সংবাদ

জলদস্যুদের হাতে ৩১ দিন জিম্মি থাকার পর মুক্তি পেয়েছেন ২৩ জন নাবিক : জিম্মিদশার লোমহর্ষক বর্ণনা দিলেন জাহাজের ক্যাপ্টেন

আপডেট সময় ০৯:০০ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৭ এপ্রিল ২০২৪
অনলাইন ডেস্ক :  ভারত মহাসাগরে সোমালিয়ার জলদস্যুদের হাতে ৩১ দিন জিম্মি থাকার পর মুক্তি পেয়েছেন বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আব্দুল্লাহর ২৩ জন নাবিক। গেল রবিবার রাতে চট্টগ্রামের কেএসআরএম গ্রুপের এই জিম্মি জাহাজ থেকে নেমে যায় সোমালিয়ার জলদস্যুরা। কীভাবে কাটল ৩১ দিন। সেই ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন জাহাজের মাস্টার ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ আবদুর রশিদ। গত মঙ্গলবার (১৬ এপ্রিল) হোয়াটসঅ্যাপে গণমাধ্যমের কাছে জিম্মিদশার বর্ণনা দেন তিনি। ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ আবদুর রশিদ জানান, মার্চের ১২ তারিখ সকালে ২৩ বাংলাদেশি নাবিকসহ এমভি আবদুল্লাহ নীল সাগরে ছুটে চলছিল। কেবিনে অফিসের কাজ সেরে সকাল সাড়ে ৯টায় জাহাজ পরিচালনা কক্ষ- ব্রিজ থেকে মাস্টারের চেয়ারে গিয়ে বসি। বসেই জাহাজের দায়িত্বে থাকা তৃতীয় কর্মকর্তাকে বলি, সব ঠিকঠাক আছে তো? মোজাম্বিকের মাপুতো বন্দর থেকে কয়লা বোঝাই করে সোমালিয়ার উপকূল থেকে ৬০০ নটিক্যাল মাইল দূরে ভারত মহাসাগর হয়ে যাওয়ার পথে তৃতীয় কর্মকর্তা জানালেন, স্যার, জাহাজের ডান পাশে অনেক দূরে একটি ফিশিং বোট দেখা যাচ্ছে।
দৃশ্যমান সেই ফিশিং বোট থেকে ব্যবধান বাড়িয়ে দিতে জাহাজটি বাঁয়ে ঘুরিয়ে দিয়ে নৌযানটি আমরা পর্যবেক্ষণ শুরু করি। হঠাৎ করে দেখি, নৌযানটি থেকে একটি স্পিডবোট সাগরে ভাসানো হয়েছে। তখনই আমরা নিশ্চিত হয়ে যাই, জলদস্যুরা আসছে। এমভি আবদুল্লাহ জাহাজে কয়লা বোঝাই থাকায় আমাদের গতি ছিল কম। ঘণ্টায় সাড়ে ১০ নটিক্যাল মাইল।
স্পিডবোটটি কাছাকাছি চলে এলে ঢেউ সৃষ্টি করে এবং উচ্চচাপে পানি ছিটিয়ে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করি। আবার ডানে-বাঁয়ে জাহাজ ঘুরিয়ে স্পিডবোটটির গতি কমানোর চেষ্টা শুরু করি। এ সময় যুক্তরাজ্যের মেরিটাইম ট্রেড অপারেশনে যোগাযোগ করি। সেখানে কেউ ফোন ধরেননি। সে সময় যোগাযোগ করে কাছাকাছি কোনো যুদ্ধজাহাজও পাইনি।
জলদস্যুরা উঠে যাবে বুঝতে পেরে আমরা জাহাজের সুরক্ষিত কক্ষ- সিটাডেলে আশ্রয় নেওয়ার শেষ চেষ্টা করি। নাবিকের সিটাডেলে যাওয়ার নির্দেশ দিই। তবে চারজন জলদস্যু অস্বাভাবিক গতিতে ব্রিজে ওঠে পড়তে সক্ষম হয়। তারা প্রথমে দ্বিতীয় কর্মকর্তার মাথায় অস্ত্র ঠেকিয়ে ‘মাস্টার মাস্টার’ বলে চিৎকার করে। আমাকে খুঁজতে থাকে। দ্বিতীয় কর্মকর্তা ভয় পেয়ে যান। আমি দ্রুত সেখানে চলে এসে হাত তুলি। তখনই জলদস্যুরা ‘অল ক্রু’ বলে চিৎকার করতে থাকে।
এরপরই আমি সব নাবিককে ব্রিজে চলে আসার নির্দেশ দিই। নাবিকরা শুরুতে বেশ ভয় পেয়ে যান। জলদস্যুরা জাহাজের ইঞ্জিন বন্ধ করার কথা বলে। ইঞ্জিন বন্ধ করার পর মাছ ধরার নৌযানটি আমাদের জাহাজের সঙ্গে বাঁধা হয়। ওই নৌযানে একজন পাকিস্তানি এবং বাকিরা ছিলেন ইরানের জেলে। নৌযানে থাকা সব জলদস্যু জাহাজে ওঠে। মোট ১২ জন সশস্ত্র জলদস্যু আমাদের জাহাজের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। আমাদের কাছ থেকে মুঠোফোন কেড়ে নিলেও ল্যাপটপ ও কয়েকটি মুঠোফোন আমরা লুকিয়ে রেখেছিলাম। এ সময় জলদস্যুরা আনন্দ উল্লাস করতে থাকে। ফাঁকা গুলি ছোড়ে।
ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ আবদুর রশিদ জানান, নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার পর থেকে জলদস্যুদের নির্দেশনায় চলতে থাকে জাহাজটি। এবার তাদের নির্দেশে আমরা এমভি আবদুল্লাহর ইঞ্জিন চালু করি। সোমালিয়ার উপকূলের দিকে যাওয়ার নির্দেশনা দেয় জলদস্যুরা। সে সময় একজন জলদস্যু একটি নম্বরে যোগাযোগ করতে বলে। কল দেওয়ার পর ‘আহমেদ’ পরিচয় দিয়ে ফোনের অপর প্রান্ত থেকে বলা হয়, ‘হাউ আর ইউ ক্যাপ্টেন এভরিথিং ইজ ওকে’ এরপরই জাহাজটি কীভাবে কোথায় নিতে হবে, তার পথনির্দেশনা দিয়ে দেয় জলদস্যু নেতা। সে অনুযায়ী, জাহাজ চলতে থাকে।
রোজার দ্বিতীয় দিনে ইফতারের আগে ইউরোপীয় ইউনিয়নের অপারেশন আটলান্টার একটি যুদ্ধজাহাজ এমভি আবদুল্লাহর পিছু নেয়। যুদ্ধজাহাজ থেকে এমভি আবদুল্লাহ জাহাজের ভিএইচএফে জলদস্যুদের নির্দেশনা দেওয়া হয়, ‘তোমরা জাহাজ ছেড়ে যাও। না হলে অভিযান চালানো হবে।’ নির্দেশনায় কোনো কাজ হয়নি। যুদ্ধজাহাজ থেকে একটি হেলিকপ্টার আকাশে ওড়ানো হয়। একপর্যায়ে এমভি আবদুল্লাহর চারপাশে পানিতে হেলিকপ্টার থেকে গুলিবর্ষণ করা হয়। তাতেও কোনো কাজ হয়নি।
যুদ্ধজাহাজ যাতে দ্রুত চলে যায়, তা বলার জন্য আমাকে জলদস্যুরা ভয় দেখায় অস্ত্র তাক করে। আমি ভিএইচএফে জানাই, ‘আমরা অস্ত্রের মুখে আছি। তোমরা দূরে চলে যাও। প্রায় আধা ঘণ্টা পর যুদ্ধজাহাজ দূরে চলে যায়। যুদ্ধজাহাজ পিছু নেওয়ায় দুই দফা নোঙর তুলে তৃতীয় দফায় সোমালিয়া উপকূলের জেফলের দিকে এমভি আবদুল্লাহকে নিয়ে যায় জলদস্যুরা।
তিনি বলেন, মোট ৩৫ জন জলদস্যু জাহাজে ওঠে। যুদ্ধজাহাজ পিছু নেওয়ায় জলদস্যুরা জাহাজে ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আসে। রকেট লঞ্চার, মেশিনগান, এম-সিক্সটিনসহ নানা রকমের অস্ত্র। মনে হয়েছে, যেন যুদ্ধক্ষেত্রে আছি। জলদস্যুদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার না করে উপায় নেই। ভালো ব্যবহার করায় তারা আমাদের কেবিনে থাকার সুযোগ দেয়। কবে মুক্তি পাবো, মনে মনে শুধু সেই ভাবনা ভিড় করে।
আমরা ১৬ জানুয়ারি জাহাজ নিয়ে চট্টগ্রাম থেকে যাত্রা শুরু করেছিলাম। পথে শ্রীলঙ্কার হাম্বানটোটা বন্দর হয়ে মোজাম্বিকের মাপুতো থেকে কয়লা বোঝাই করেছিলাম। চট্টগ্রাম ছেড়ে যাওয়ার আগে প্রায় ১৪ লাখ টাকার বাজারসদাইয়ের ব্যবস্থা করে দিয়েছিল জাহাজটির মালিকপক্ষ এসআর শিপিং (কেএসআরএম গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান)। জাহাজে তিন মাসের খাবার ছিল। জলদস্যুরা জাহাজে দুম্বা নিয়ে আসত। গরম পানিতে সেদ্ধ করে লবণ ও কিছু মসলা মিশিয়ে তারা তা খেত। এগুলো আমাদের জন্য খাওয়ার অযোগ্য ছিল। একপর্যায়ে তারা নিজেদের রান্না করার জন্য লোক নিয়ে আসে জাহাজে। আমরা ইফতারের সময় লেবুসহ নানা ধরনের শরবত পান করতাম। সেহরিতে ভাতের পাশাপাশি দুধ থাকত। জাহাজে পানি শেষ হয়ে গেলে বিপদে পড়ব- এমন আশঙ্কায় শুধু খাবার পানি সরবরাহ ঠিক রাখতাম আমরা।
এদিকে, গণমাধ্যমসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছবি দেখে জলদস্যুরা প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হয়। তাদের সন্দেহ হয়, নিশ্চয়ই নাবিকদের কাছে মুঠোফোন আছে। আহমেদ বলতে থাকে, ‘তোরা এই ছবি পাঠিয়েছিস’ পরে আমরা বলি, ‘মুঠোফোন নয়, ল্যাপটপ দিয়ে ছবি পাঠানো হয়েছে।’ পরে ল্যাপটপ কেড়ে নেয় জলদস্যুরা।
জলদস্যুদের ভিডিও করার বর্ণনা দিয়ে মোহাম্মদ আবদুর রশিদ বলেন, মুক্তি পাওয়ার দুই দিন আগে হঠাৎ আহমেদ এসে সবাইকে ডেকে নিয়ে দাঁড়াতে বলে। সে আমাদের ভিডিও করতে শুরু করে। তার কথা অনুযায়ী, আমি নাবিকদের নাম জিজ্ঞাসা করে পরিচয় করে দিই। শুনেছি, এই ভিডিও তারা কেএসআরএম গ্রুপের কাছে পাঠিয়েছে। আমরা যে সুস্থ আছি, তা দেখতে চেয়েছে কেএসআরএম গ্রুপ। আমাদের মনে তখন আশার সঞ্চার হয়। এর দুদিন পর আবার সব নাবিককে ডেকে এক লাইনে দাঁড় করিয়ে রাখে জলদস্যুরা। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর দেখি, ছোট আকারের একটি উড়োজাহাজ আসছে। অদূরে দুটি যুদ্ধজাহাজ। আমরা ভয় পেয়ে যাই। কারণ, তখন এমভি আবদুল্লাহ জাহাজে ৬৫ জন জলদস্যু। তাদের কাছে ভারী অস্ত্রশস্ত্র আছে।
জলদস্যুদের নির্দেশে এমভি আবদুল্লাহর নোঙর তুলে পেছনের দিকে সরিয়ে নিতে থাকি। জাহাজ পেছনের দিকে সরিয়ে নেওয়া হতে থাকে। একপর্যায়ে দেখতে পাই, রাতে তীর থেকে জাহাজের দিকে আলো ফেলে ইশারা দেওয়া হচ্ছে। জলদস্যুদের নির্দেশে জাহাজের ইঞ্জিন বন্ধ করা হয়। এ সময় পাঁচটি স্পিডবোটে করে সব জলদস্যু অস্ত্রসহ জাহাজ থেকে নেমে যায়। তখন সোমালিয়ার সময় ১৩ এপ্রিল দিবাগত রাত ১২টা ৮ মিনিট অর্থাৎ ১৪ এপ্রিল প্রথম প্রহর।
জলদস্যুরা নেমে যাওয়ার পর জাহাজটি ঘুরিয়ে সোমালিয়া উপকূল ত্যাগ করতে শুরু করি। সবাই পরিবার ও স্বজনদের কাছে মুক্তির বার্তা দিতে ধাকে। এ সময় সবার মধ্যে জীবন ফিরে পাওয়ার আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। রাতের বেলায় জাহাজ চলছে। দুই পাশে তখন ইউরোপীয় ইউনিয়নের নৌবাহিনীর দুটি যুদ্ধজাহাজ। ইউরোপীয় ইউনিয়নের নৌবাহিনীতে থাকা চিকিৎসকেরা আমাদের সব নাবিকের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করেন। স্প্যানিশ নৌবাহিনীর একজন নারী চিকিৎসক আমাকে বলেন, ‘সব নাবিক সুস্থ আছেন।’ তিনি বলেন, আমরা জলদস্যুদের হাত থেকে এত দ্রুত মুক্তি পাব তা কল্পনাও করিনি। সোমালিয়ার উপকূল থেকে জিম্মি জাহাজের এক মাসের মধ্যে মুক্তি পাওয়ার ঘটনার নজির খুব একটা নেই। জিম্মিদশার পর থেকে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর সদর দপ্তর সার্বক্ষণিক আমাদের জাহাজের অবস্থানের ওপর নজর রেখেছে। তারা ইউরোপীয় ইউনিয়নের নৌবাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে সব সময় আমাদের পাশেই ছিল। এমভি আব্দুল্লাহর বর্তমান অবস্থা প্রসঙ্গে তিনি জানান, গতকাল মঙ্গলবারও জাহাজটি ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে ছিল। তবে বুধবার সেই ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা অতিক্রম করবে। সে ক্ষেত্রে ২২ এপ্রিল দুপুরের মধ্যে জাহাজটি সংযুক্ত আরব আমিরাতের আল হামরিয়া বন্দরে পৌঁছাতে পারে।
এই মুক্তির জন্য আমরা প্রধানমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞ জানাই। তারা সহযোগিতা না করলে মুক্তি সম্ভব হতো না বলে মনে করেন ক্যাপ্টেন আবদুর রশিদ।