সিনিয়র রিপোর্টার
নাগরিক সমাজ, বুদ্ধিজীবী ও শিক্ষক প্রতিনিধিদের সবাই তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বহাল করার বিষয়ে একমত হয়েছেন। নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার বিষয়ে তাদের সঙ্গে বৈঠকে বসেছিল নির্বাচন সংস্কার কমিশন। রবিবার (২৪ নভেম্বর) সকাল সাড়ে ১০টায় নির্বাচন কমিশন (ইসি) ভবনে সংস্কার কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদারের সভাপতিত্বে বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার বিষয়ে বিভিন্ন অংশীজনদের সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠক করছে নির্বাচন সংস্কার কমিশন।
বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের সামনে ১৩ বছর আগে বাতিল হওয়া তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ফেরানোর ইঙ্গিত দিয়েছেন নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার। তিনি বলেন, এই আলোচনা থেকে যেটি সুস্পষ্ট হলো- তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিষয়ে সবাই একমত হয়েছেন। নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীন করতে হবে, শক্তিশালী করতে- বিশেষ করে আর্থিক স্বাধীনতা দিতে হবে। নির্বাচন কমিশনকে সরকারের অধীনে আরেকটি সরকার হতে হবে- এমনভাবে তারা শক্তিশালী হবে।
সংলাপে না ভোটের বিধান রাখার ব্যাপারে সবাই একমত ছিলেন বলে জানান বদিউল আলম মজুমদার। তিনি বলেন, আগের নির্বাচন কমিশন যে বিতর্কিত, কলঙ্কজনক ও পাতানো নির্বাচন করেছে, তার মাধ্যমে তারা শপথ ভঙ্গ করেছে, সংবিধান লঙ্ঘন করেছে। তাদের বিচারের আওতায় আনার কথা প্রায় সবাই বলেছেন।
রাজনৈতিক দলের মধ্যে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত না হলে দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে, তা আশা করা দূরাশা বলে মনে করেন সংস্কার কমিশনের প্রধান। জাতীয় সংসদে নারীদের জন্য সরাসরি আসন থাকতে হবে এবং প্রত্যক্ষ নির্বাচন হতে হবে বলেও উল্লেখ করেন বদিউল আলম মজুমদার। তিনি বলেন, ‘আমরা যে ঘূর্ণায়মান পদ্ধতির কথা বলেছি, তা-ও হতে পারে, অন্য পদ্ধতিও হতে পারে।’
সংলাপে নির্বাচন কমিশনের আইন পরিবর্তন করা, পিআর সিস্টেমসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হয়েছে বলে জানান সংস্কার কমিশনের প্রধান। রাষ্ট্রপতি নির্বাচন প্রসঙ্গে বদিউল আলম মজুমদার বলেন, সরাসরি নির্বাচনের কথা অনেকে বলেছেন। রাষ্ট্রপতির পদকে আরো শক্তিশালী করার কথা বলেছেন।
বদিউল আলম বলেন, আমরা ডায়ালগ করেছি, খোলামেলা কথা বলেছি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিরোধিতা করেননি কেউ। নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীন হওয়ার কথা বলছেন সবাই। ভোটের বিষয়ে সবাই একমত। রাজনৈতিক দলের মধ্যে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত না হলে দেশও গঠন হবে না।
বদিউল আলম বলেন, যারা এসেছিলেন তারা অনেক অভিজ্ঞ গবেষক। আমরা তাদের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করেছি। তিনি বলেন, নাগরিক সমাজের যারা এসেছেন, তারা সবাই ‘না’ ভোটের বিধান চালু করার কথা বলেছে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্য গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার দাবি জানিয়েছে।
সংসদে সংরক্ষিত আসন প্রসঙ্গে বদিউল আলম মজুমদার বলেন, সংসদে সংরক্ষিত নারী আসনে সরাসরি ভোটে ব্যবস্থা করার কথা বলেছেন এবং নারীর জন্য সরাসরি আসন থাকতে হবে ও প্রত্যক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে। নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সদস্য আবদুল আলীম, জেসমিন টুলী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক আল মাসুদ হাসানুজ্জামান, চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন সভায় অংশ নেন।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বিরোধী দলগুলোর আন্দোলনের চাপে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান এনে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী সংসদে পাস করে বিএনপি। পরে আবার আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফিরলে ২০১০ সালের ১ মার্চ আপিল বিভাগে ত্রয়োদশ সংশোধনী মামলার শুনানি শুরু হয়। শুনানিতে আপিল আবেদনকারী এবং রাষ্ট্রপক্ষ ছাড়াও অ্যামিকাস হিসেবে শীর্ষস্থানীয় আটজন আইনজীবী বক্তব্য দেন। তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বহাল রাখার পক্ষে মত দেন। এমনকি তৎকালীন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমও এর পক্ষে মত দেন। ওই আপিল মঞ্জুর করে সাত বিচারপতির পূর্ণাঙ্গ আপিল বেঞ্চ ২০১১ সালের ১০ মে সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতের ভিত্তিতে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল ঘোষণা করে রায় দেন। তখন প্রধান বিচারপতি ছিলেন এবিএম খায়রুল হক। পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ হওয়ার আগেই ২০১১ সালের ৩০ জুন জাতীয় সংসদে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পাস হয় এবং রাষ্ট্রপতি ৩ জুলাই তাতে অনুমোদন দেন। ওই সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করা হয় এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে জাতির পিতা হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত আগস্টে পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল চেয়ে একটি রিট আবেদন করেন সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারসহ পাঁচজন। আগস্ট মাসেই ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায় পুনর্বিবেচনার জন্য আপিল বিভাগে আবেদন (রিভিউ) করেন সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারসহ পাঁচজন। পরে একই আর্জি জানিয়ে আরেকটি আবেদন করেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
বিদ্যমান নির্বাচনী ব্যবস্থা সংস্কারের লক্ষ্যে গত ৩ অক্টোবর সুজন সাধারণ সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারকে প্রধান করে আট সদস্যবিশিষ্ট সংস্কার কমিশন গঠন করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। ৯০ দিনের মধ্যে এই কমিশনের প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা।
২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে অনুষ্ঠিত নবম সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশের নাগরিকরা প্রথমবারের মতো ‘না ভোট’ দেওয়ার সুযোগ পায়। ওই নির্বাচনে মোট তিন লাখ ৮১ হাজার ৯২৪ জন ‘না’ ভোট দিয়েছিলেন। ‘না’ ভোটের এই পরিমাণ ছিল বাক্সে পড়া মোট ভোটের শূন্য দশমিক ৫৫ শতাংশ। তখন গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের ৪০(ক) ধারায় বলা ছিল, যদি ‘না ভোট’ সর্বোচ্চ ভোট পাওয়া প্রার্থীর ভোটকে ছাড়িয়ে যায়; সেক্ষেত্রে নতুন করে নির্বাচন হবে। আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধন করা হলে তাতে ‘না’ ভোটের বিধান বাদ পড়ে।