সিনিয়র রিপোর্টার
শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ, কবি নজরুল সরকারি কলেজ এবং ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের (ডিএমআরসি) শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষ ও ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ায় রাজধানীর ডেমরা-যাত্রাবাড়ী এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে স্থানীয়রাও। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ আনতে সেখানে সেনাবাহিনী, র্যাব, বিজিবি, এপিবিএন ও পুলিশের কয়েকশ’ সদস্য দেখা গেছে। বিকাল ৩টার পর থেকে মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের সামনে প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষার্থী, স্থানীয় বাসিন্দা ও উৎসুক জনতা দেখা গেছে। এরপর থেকে সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ ও কবি নজরুল সরকারি কলেজের শিক্ষার্থীদের দেখা যায়নি।
এর আগে সোমবার (২৫ নভেম্বর) বেলা ১২টা থেকে মোল্লা কলেজের সামনে প্রায় দুই ঘণ্টার এ সংঘর্ষে শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। তাদেরকে নেওয়া হয়েছে ঢাকা মেডিক্যাল, ন্যাশনাল মেডিক্যালসহ বিভিন্ন হাসপাতালে।
সংঘাতে মোল্লা কলেজের তিন শিক্ষার্থী নিহত হয়েছেন বলে দাবি করেছিলেন প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আশরাফ সামীর। পরে তা প্রত্যাহার করা হয়। তিনি এক বিবৃতিতে বলেছেন, এ হামলায় শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ এবং ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজের কিছু ছাত্র নামধারী ব্যক্তি নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের মদদে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অস্থিতিশীল করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল। হামলাকারীদের অধিকাংশই শিক্ষার্থী নয়, বরং সন্ত্রাসী কার্যক্রমে লিপ্ত ব্যক্তিবর্গ। এদিকে সংঘাতে কোনো প্রাণহানির খবর পুলিশের তরফে নিশ্চিত করা হয়নি।
ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের প্রতিষ্ঠাতা ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া এবং সংঘর্ষের ঘটনায় কেউ নিহত হননি। একটি মহল নিহত হওয়াও খবর ছড়িয়ে দেশের পরিবেশকে অশান্ত করতে চেয়েছে।’
আহতরা হলেন- সোহরাওয়ার্দী কলেজের এইচএসসি প্রথম বর্ষের রাজীব (১৯), শাহেদুল (২০), আশিকুল (২১), রোহান (১৯), সম্রাট (১৮), জয় (১৮)।
কবি নজরুল সরকারি কলেজের এইচএসসি প্রথম বর্ষের রানা (২০), মারুফ (১৯), হাসিনুর (১৯), সিফাত (১৮), জাহেদুল (২১), আসিফ মাহমুদ (১৮), সাকির (১৯), জুবায়ের রহমান সাজ্জাদ (১৯), সৈকত (১৯), জারিফ (১৮), এইচএসসি দ্বিতীয় বর্ষের আরাফাত (১৯), মারুফ (২২), অনার্স প্রথম বর্ষের অনুপম দাস (২৩), জুয়েল ইসলাম (২২), নাঈম (২২), অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের সুমন (২২)।
ইম্পেরিয়াল কলেজের প্রথম বর্ষের হুমায়ুন (২০)। সলিমুল্লাহ কলেজের এইচএসসি প্রথম বর্ষের রুমান (১৯), নোমান (২০), এইচএসসি দ্বিতীয় বর্ষের সাইদুল ইসলাম (১৯), অনয় (২১), আব্দুর রহমান (২০), অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের রাজীব (২৪)।
মাহবুবর রহমান মোল্লা কলেজের এইচএসসি প্রথম বর্ষের নাফি (১৮) (গুলিবিদ্ধ), অনার্স প্রথম বর্ষের ইনতিয়াক (২২)। দোলাইপাড় এ কে স্কুলের এসএসসি পরীক্ষার্থী তাসরিফ (১৮)।
দনিয়া ব্রাইট স্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্র মাহিম হোসেন (১৫)। রাজারবাগ পুলিশ লাইন স্কুল অ্যান্ড কলেজের এইচএসসি প্রথম বর্ষের আরাফাত (১৯)।
ঢামেক হাসপাতালের পুলিশ ক্যাম্পের ইনচার্জ পরিদর্শক মো. ফারুক বলেন, যাত্রাবাড়ী থেকে আহত অবস্থায় অন্তত ৩৫ জনকে ঢাকা মেডিক্যালের জরুরি বিভাগে নিয়ে আসা হয়। এদের মধ্যে বেশিরভাগ শিক্ষার্থী মাথায় এবং শরীরে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে।
এদিকে হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত মোল্লা কলেজ ও আশপাশের এলাকা নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে পুলিশ- সেনাবাহিনীসহ আরো আইনশৃঙ্খলার বিভিন্ন বাহিনীর সদস্যরা। এর মধ্যে মোতায়েন করা হয়েছে ছয় প্লাটুন বিজিবি সদস্য।
পুরান ঢাকার ন্যাশনাল মেডিক্যালে মাহাবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের শিক্ষার্থী অভিজিৎ হাওলাদারের মৃত্যুর ঘটনায় রবিবার ঘেরাও কর্মসূচি দেওয়া হয়েছিল। পূর্বঘোষিত সেই ‘সুপার সানডে’ কর্মসূচির মধ্যে ঢাকা ন্যাশনাল মেডিক্যাল ও পাশের সোহরাওয়ার্দী কলেজে ব্যাপক ভাঙচুর চালায় মোল্লা কলেজসহ কয়েকটি কলেজের শিক্ষার্থীরা। ওই সময় সোহরাওয়ার্দী কলেজ কেন্দ্রে অনার্স প্রথম বর্ষের পরীক্ষা দিচ্ছিলেন নজরুল কলেজের শিক্ষার্থীরা। গণ্ডগোলের মধ্যে নিরাপত্তার কারণে মাঝপথে পরীক্ষা স্থগিত করা হয়। ওই হামলা ও লুটপাটের প্রতিবাদে সোমবার ‘মেগা মানডে’ কর্মসূচির ডাক দেন সোহরাওয়ার্দী কলেজ ও কবি নজরুল সরকারি কলেজের শিক্ষার্থীরা।
এর অংশ হিসেবে এদিন সকাল থেকে সোহরাওয়ার্দী কলেজের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থীরা খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে ক্যাম্পাস প্রাঙ্গণে জড়ো হতে শুরু করেন। পরে তারা মিছিল নিয়ে কবি নজরুল কলেজের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে রওনা হন ডেমরা সড়ক সংলগ্ন মোল্লা কলেজে। সেখানে তাদের সঙ্গে মোল্লা কলেজের শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষ নিয়ে পরস্পরবিরোধী বক্তব্য পাওয়া গেছে।
মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের উচ্চ মাধ্যমিক দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র রাতুল সরকার বলেন, ফেসবুকে ঘোষণা দিয়েছিল তারা- এটি সবাই জানে। তারা হামলা করলে আমরা পুলিশকে আসতে বলি ৯৯৯-এ কল দিয়ে। পুলিশ এসেছে অনেক পরে।
সেনাবাহিনীও আড়াইটার পরে আসে জানিয়ে তিনি বলেন, অল্প কয়েকজন পুলিশ ছিল প্রথমে। তারা হামলার শুরুতে দূরে সরে যায়। সেনাবাহিনী, পুলিশ আগে আসলে কোনো ক্ষতি হতো না।
হামলায় মূল সড়কের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ১০ তলা উঁচু ভবনের সামনের অংশের কাঁচ ভেঙে দেয়। আর পেছনের তিনটি ভবনের বেশিরভাগ কক্ষই ক্ষতিগ্রস্ত হয়; বেঞ্চ, সিলিং ফ্যান, সিসি ক্যামেরা, চেয়ার টেবিল ভাঙচুর করা হয়। ভাঙচুর হওয়া ক্ষতিগ্রস্ত ভবনের মধ্যে অধ্যক্ষের অফিস, ল্যাবরেটরি ও ল্যাবও আছে।
মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের শিক্ষার্থীদের পক্ষে চার কিলোমিটার দূরের সানারপাড় রওশন আরা কলেজ থেকে আসেন শিক্ষার্থী সাকিব হাওলাদার। তিনি বলেন, আমাদের ফেসবুক গ্রুপ আছে কলেজের ছাত্রদের নিয়ে। সেখানেই ঘোষণা করা হয়েছিল রবিবার রাতে আজকে এই কলেজে হামলা হবে। ঘটনার বর্ণনায় তিনি বলেন, প্রথম দফার হামলায় আমরা কম ছিলাম। তারা তো শত শত ছিল। কয়েক হাজারের মত। পুলিশও চলে গিয়েছিল। পড়ে আমরা এলাকাবাসীদের নিয়ে তাদের ওপর হামলা করলে চলে যায়। তাদের সঙ্গে বাইরের লোকও (অছাত্র) ছিল।
তবে সোহরাওয়ার্দী কলেজের শিক্ষার্থী তুহিন বলেন, রবিবার মোল্লা কলেজের নেতৃত্বে ঢাকার বেশ কয়েকটি কলেজ একত্রিত হয়ে কবি নজরুল ও সোহরাওয়ার্দী কলেজে হামলা ও ভাঙচুর চালায়। এ ঘটনায় সোহরাওয়ার্দী কলেজের অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়ে গেছে। আমরা রবিবার রাত থেকে সোমবার সকাল ১০টা পর্যন্ত প্রশাসনকে সময় দিয়েছিলাম এ ঘটনার সুষ্ঠু একটা সমাধান করার জন্য। কিন্তু আমাদের দেওয়া সময়ের ভেতর তেমন কোনো পদক্ষেপ নেয়নি তারা। তাই আজ সুষ্ঠু বিচারের দাবিতে আমরা দুইটি কলেজের শিক্ষার্থীরা একত্রিত হয়ে সেখানে গেলে তারা আমাদের ওপর হামলা চালায়।
তুহিনের ভাষ্য, আমাদের কিছু শিক্ষার্থী তাদের ধাওয়া করে মোল্লা কলেজের দ্বিতীয় তলায় উঠলে তারা আমাদের অনেক শিক্ষার্থীদের অবরুদ্ধ করে রাখে। রুমের ভেতর তাদের ওপর নারকীয় তাণ্ডব চালায়।
সোহরাওয়ার্দী কলেজের আরেক শিক্ষার্থী ফাহিম বলেন, আমরা সুষ্ঠু বিচারের দাবি নিয়ে সেখানে গেলে- তাদের পোলাপান প্রস্তুত ছিল আমাদের ওপর হামলা করার জন্য। আমদের বেশ কিছু শিক্ষার্থী সেখানে অবরুদ্ধ হলে আহতদের নিয়ে আমরা ক্যাম্পাসে চলে আসি। তাদের মধ্যে যারা গুরুতর আহত তাদের ঢাকা মেডিক্যালে আর বাকিদের ন্যাশনাল হাসপাতালে নিয়ে এসেছি।
মোল্লা কলেজের শিক্ষার্থী আব্দুল হাই শিকদার বলেন, হামলা করতে আসারা তো অনেক বড়। কারো কারো আইডি কার্ড ছিল গলায়। বাকিদের ছিল না। তারা হামলায় করে আমাদের কলেজ ভাঙছে। কিছু রাখে নাই। উপর থেকে ফেলে দিয়েছে সব।
বেলা সোয়া ৪টার দিকে সেনাবাহিনী মাইকে ঘোষণা দেয় পথচারী ও এলাকাবাসীদের চলে যেতে অনুরোধ করে। এসময় সেনাবাহিনীর গাড়িকে অনুসরণ করে ছোট ছোট যান চলাচল করতে দেখা যায়।
কোনো শিক্ষার্থী নিহত হয়নি : ডিএমপি
শিক্ষার্থীদের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া এবং সংঘর্ষের ঘটনায় কেউ নিহত হননি বলে জানিয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। দুই-তিনজন নিহত হওয়ার অপপ্রচার থেকে সবাইকে বিরত থাকার অনুরোধ জানিয়েছে ডিএমপি। সোমবার সন্ধ্যায় ডিএমপির মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মুহাম্মদ তালেবুর রহমান এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
বিজিবি মোতায়েন : সোহরাওয়ার্দী কলেজ, কবি নজরুল কলেজের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষকে কেন্দ্র করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী-ডেমরা এলাকায় ছয় প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে। সোমবার বিজিবির জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. শরীফুল ইসলাম এ তথ্য জানিয়েছেন।
হামলাকারীদের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আইনের আওতায় আনা হবে: ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজে হামলাকারীদের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আইনের আওতায় আনা হবে বলে জানিয়েছেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) ওয়ারী বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মো. ছালেহ উদ্দিন। সোমবার বিকাল সোয়া ৪টার দিকে ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের সামনে সাংবাদিকদের তিনি এ কথা বলেন। এর আগে, তিনি সেনাবাহিনীর সদস্যদের নিয়ে কলেজের ভেতরে পরিদর্শন করেন এবং কলেজ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করেন।
ডিসি মো. ছালেহ উদ্দিন বলেন, এ ঘটনাকে আমরা দুর্ঘটনা বলবো না। একটি অবৈধ সমাবেশের মাধ্যমে ছাত্রবেশে সন্ত্রাসীরা আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটাতে চায়। তারা সংঘবদ্ধ হয়ে ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজে হামলা করেছে। আমাদের সীমিত পুলিশ সদস্যরা প্রথমে যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তায় তাদের আটকে দেওয়ার চেষ্টা করেছি। তারা আমাদের প্রতিবন্ধকতা উপেক্ষা করে তারা লাঠিসোঁটা নিয়ে মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজে হামলা করেছে। তিনি আরও বলেন, আমরা সেনাবাহিনীর সদস্যদের নিয়ে কলেজের ভেতরে প্রবেশ করেছি। বিভিন্ন তলার বিভিন্ন কক্ষ পরিদর্শন করেছি। এখানে ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়। কোটি কোটি টাকার সম্পদ লোপাট হয়েছে, যা খুবই নেক্কারজনক। একটি স্বার্থন্বেষী মহল এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত বলে আমরা মনে করছি।
কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়ে পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, ‘এ ধরনের কোনো ঘটনা আর বরদাস্ত করবো না। যারা এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত, তাদের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আইনের আওতায় আনবো। এই ঘটনায় মামলা হবে এবং পরবর্তী যে আইনানুগ প্রক্রিয়াগুলো আছে সেগুলোতে আপনারা (এলাকাবাসী) সহযোগিতা করবেন।
যা বলছে সরকার : সংঘর্ষে না জড়িয়ে শিক্ষার্থীদের শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়েছে সরকার। এসব সংঘাতের পেছনে কোনো ধরনের ইন্ধন থাকলে তা কঠোর হাতে দমন করা হবে বলে সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। সোমবার প্রধান উপদেষ্টার প্রেসসচিব শফিকুল আলম এ কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘সম্প্রতি বেশ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যে সংঘাত-সংঘর্ষ হয়েছে, সরকার তার প্রতি নজর রাখছে। আমরা ছাত্র-ছাত্রীদের কোনো ধরনের সংঘর্ষে না জড়িয়ে শান্ত থাকার আহ্বান জানাচ্ছি।’