সিনিয়র রিপোর্টার : প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান বলেছেন, আইনপেশা পরিচালনায় আইনজীবীদেরকে তাদের পেশাগত নৈতিক মানদণ্ড রক্ষায় গুরুত্ব দিতে হবে। পেশাগত নৈতিকতা ও মূল্যবোধের যথাযথ অনুশীলন আইন পেশার মূলভিত্তি। যদি পেশাগত মূল্যবোধের অনুশীলন ব্যতিরেকে আইন চর্চা করা হয়, তবে আমাদের বিচারাঙ্গন পরিণত হবে নিছক কাঠ-পাথরের কিছু স্থাপনায়।

সোমবার (৬ মে) সন্ধ্যায় সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি আয়োজিত ‘আইন পেশার আদর্শ ও নৈতিকতা’ এবং ‘বিচারিক পর্যালোচনা’ শীর্ষক সেমিনার উদ্ভোধনের পর প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। সুপ্রিম কোর্ট বার এই সেমিনারের আয়োজন করে। সুপ্রিম কোর্ট বার এর শহীদ সফিউর রহমান মিলনায়তনে এই সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়।

সমিতির সভাপতি ব্যারিস্টার এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকনের সভাপতিত্বে ও সম্পাদক অ্যাডভোকেট শাহ মঞ্জুরুল হকের সঞ্চালনায় সেমিনারে মূল সেশনে বক্তব্য দেন আপিল বিভাগের বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি নাইমা হায়দার। সেমিনারে বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন।

প্রধান বিচারপতি বলেন, যদি বিচারাঙ্গনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত আইনজীবীরা আইন পেশা পরিচালনায় পেশাগত নৈতিক মানদণ্ড রক্ষায় যদি যথাযথ গুরুত্ব প্রদান না করেন, তাহলে মানুষের অধিকার রক্ষার মাধ্যমে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার যে মহান উদ্দেশ্য নিয়ে দেশের বিচারালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, যে উদ্দেশ্যের কথা প্রোথিত রয়েছে  আমাদের মহান সংবিধানে, সেই উদ্দেশ্য সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়ে যাবে। আমাদের সমাজের সবচেয়ে অসহায় মানুষরা তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আদালতে আসেন, আইনজীবীদের দ্বারস্থ হন। এ অসহায় মানুষগুলোকে আইনি সেবা প্রদানের যে নৈতিক দায়িত্ব আইনজীবীর রয়েছে, সেই দায়িত্ব পালনে আমাদের সবাইকে মানবিক হতে হবে।

মনে রাখতে হবে, আইনজীবী হিসেবে আপনার সাফল্য কেবল মামলার জয়-পরাজয়ের নিক্তিতে মাপলেই চলবে না। বরং আদালতে আইনের ব্যাখ্যা প্রদানে আপনি কতটা মানবিকতা ও উদারতার পরিচয় দিচ্ছেন কিংবা মামলায় জয় লাভের তুলনায় আপনি ন্যায় প্রতিষ্ঠায় গুরুত্ব প্রদান করছেন কি না এ বিষয়গুলোই কিন্তু আপনাকে একজন সত্যিকারের আইনজীবী হিসেবে অন্যদের কাছে পরিচয় করিয়ে দেবে।

ওবায়দুল হাসান বলেন, একজন আইনজীবীর অন্যতম প্রধান দায়িত্ব মক্কেলের গোপনীয়তা রক্ষা করা। উন্নত রাষ্ট্রগুলোতে এ বিষয়টা যতটা গুরুত্বসহকারে দেখা হয়, আমরা ততটা গুরুত্ব প্রদান করি না। কিন্তু আমাদের এ বিষয়ে সচেতন হতে হবে।মামলা পরিচালনাকালে আইনজীবীরা যেন আদালতকে সঠিক গাইড করেন। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় আইনজীবীরা আদালতের অফিসার হিসেবে ভূমিকা রাখবেন। এ সময় প্রধান বিচারপতি বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের ক্যাননস এন্ড এটিক্যাট বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দেন। তাছাড়া বিশ্বের অনেক দেশে নৈতিকতার ওপর পড়াশুনা রয়েছে। আমাদের এখানে আমরা নৈতিকতার কথা বলি কিন্তু ধারণ করিনা। 

আইনজীবীদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, আইনজীবীরা নির্দিষ্ট একটি পরিসরে তাদের পেশাগত কার্যক্রম পরিচালনা করেন বিধায় এখানে প্রতিযোগিতা থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু এই প্রতিযোগিতা যেন হয় সুস্থ আইনি প্রতিযোগিতা। ক্লায়েন্ট বা মামলা নিয়ে হোক বা ব্যক্তিগত বা প্রফেশনাল জেলাসির কারণে হোক, আইনাঙ্গনে নিজেদের মধ্যে কদর্য প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হবেন না। আইন যতই নিরস হোক না কেন আইন পেশা পরিচালনাও একটা শিল্প। এই শিল্পের সৌন্দর্য যেন মলিন না হয় সেদিকে আইনজীবীদের খেয়াল রাখতে হবে।

আধুনিক লিগ্যাল সিস্টেমে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় জুডিশিয়াল রিভিউ এর গুরুত্ব তুলে ধরে তিনি আরও বলেন, জুডিশিয়াল রিভিউ দ্বারা রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা নিশ্চিত করা হয়। সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক যে কোনো আইন, বিধান বা যে কোন কার্যক্রমের বৈধতা জুডিশিয়াল রিভিউ দ্বারা পরীক্ষা করা হয়। দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্ট বিশেষ করে হাইকোর্ট বিভাগ জুডিশিয়াল রিভিউ প্রয়োগ করে আসছে। সরকারি কার্যক্রমের বৈধতা নিরুপণে জুডিশিয়াল রিভিউ প্রয়োগ করা হয়। সংবিধানের শ্রেষ্ঠত্ব রক্ষায় রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আদালত জুডিশিয়াল রিভিউ যথাযথভাবে প্রয়োগ করে। এই প্রসঙ্গে গত দশকে সংবিধানের বেশ কয়েকটি সংশোধনী নিয়ে সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের প্রসঙ্গ তুলে ধরেন তিনি।

প্রধান বিচারপতি সুপ্রিম কোর্ট বার আয়োজিত সেমিনারের বিষয়বস্তুর প্রশংসা করে বলেন, এই ধরনের আয়োজন অসাধারণ। গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সেমিনার আয়োজনের জন্য সুপ্রিম কোর্ট বারকে ধন্যবাদ জানান প্রধান বিচারপতি।

সুপ্রিম কোর্ট বার সম্পাদক সিনিয়র অ্যাডভোকেট শাহ মঞ্জুরুল হক বলেন, বার ও বেঞ্চের সম্পর্ক উন্নয়নে এই সেমিনার আয়োজন করা হয়েছে। তিনি বলেন, সুপ্রিম কোর্ট বার নির্বাচনে এটি তার অঙ্গীকার ছিল। প্রতিমাসে এরূপ আয়োজনের আশা প্রকাশ করেন শাহ মঞ্জুরুল হক। এজন্য সংশ্লিষ্ট সকলের সহযোগিতা কামনা করেন সুপ্রিম কোর্ট বার সম্পাদক।

এর আগে অনুষ্ঠানের শুরুতেই সুপ্রিম কোর্টের প্রয়াত ও বিশিষ্ট আইনজীবীদের স্মরণ ও শ্রদ্ধা জানিয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। এই সময় সুপ্রিম কোর্ট বার সম্পাদক শাহ মঞ্জুরুল হক, বার এর সাবেক সভাপতি প্রয়াত আবদুল বাসেত মজুমদার, মাহবুবে আলম, মইনুল হোসেন, আব্দুল মতিন খসরু, এ জে মোহাম্মদ আলী, বিশিষ্ট আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল হকসহ প্রয়াত আইনজীবীদের স্মরণ ও শ্রদ্ধা জানান।    

এ সময় উপস্থিত ছিলেন সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতিগণ, সুপ্রিম কোর্ট রেজিস্ট্রির বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা বৃন্দ, সিনিয়র এডভোকেট, সুপ্রিম কোর্ট বার এর কার্যনির্বাহী কমিটির নেতৃবৃন্দসহ বিপুল সংখ্যক আইনজীবী।